জুমার রাত ও দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল

প্রকাশিত: ২:০৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২৪

ধর্ম ডেস্ক: জুমার দিনটি এবং এই দিনের আমল সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এককভাবে অন্য কোনো দিন বা দিনের নামাজ নিয়ে এত বর্ণনা আর পাওয়া যায় না। আমলের দিক থেকে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা যেসব দিনকে ফজিলত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছেন, জুমা তার অন্যতম।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে প্রথম মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কোরবানি করল; দ্বিতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন একটি গরু কোরবানি করল; তৃতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল এবং সে যেন একটি ছাগল কোরবানি করল। অতঃপর চতুর্থ যে ব্যক্তি মসজিদে গেল, সে যেন একটি মুরগি সদকা করল। আর পঞ্চম যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ডিম সদকা করল। এরপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুতবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যায়’। (বুখারি: ৮৮১)

জুমা সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তের পর থেকে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত জুমার পরিধি। শুধু জুমার নামাজ আদায় করাকেই জুমার একমাত্র আমল মনে করার কোনো অবকাশ নেই, বরং জুমার রাত ও দিন জুড়ে রয়েছে আরো অনেক আমল।

১. বেশি ইবাদত করা: মহান আল্লাহ তার বান্দার ইবাদতের জন্য জুমার দিনকে নির্বাচন করেছেন। তাই এদিনে একটু বেশিই ইবাদত করা উচিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমরা পৃথিবীতে সর্বশেষ আগমনকারীরাই কেয়ামতের দিন অগ্রবর্তী থাকব। তবে পার্থক্য হলো তাদের আমাদের পূর্বে আল্লাহর কিতাব প্রদান করা হয়েছে আর আমাদের তা প্রদান করা হয়েছে তাদের পরে। অতঃপর তাদের ইবাদতের জন্য এ দিনটি অর্থাৎ জুমার দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা (ইহুদি-খ্রিস্টানরা) এ দিনটির ব্যাপারে মতবিরোধ করল। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করলেন। ইহুদিরা পরের দিন (শনিবার) আর খ্রিস্টানরা তার পরের দিন (রবিবার)-কে গ্রহণ করল। (বুখারি, হাদিস : ৮৩৬; মুসলিম, হাদিস: ২০১৫)

২. মাগরিব ও এশায় বিশেষ কিরাত: জুমার রাতে মাগরিব নামাজে সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করা আর এশার নামাজে সূরা জুমা ও সূরা মুনাফিকুন তেলাওয়াত করার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

জাবির ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) জুমার রাতে মাগরিব নামাজে সূরা কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন ও সূরা কুলহু আল্লাহু আহাদ তেলাওয়াত করতেন। আর এশার নামাজে সূরা জুমা ও সূরা মুনাফিকুন তেলাওয়াত করতেন। (আস-সুনানুল কুবরা, হাদিস : ৫৯৪০; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ১৮৪১)

উল্লেখ্য যে ইবনে হিব্বান (রহ.) হাদিসটির সনদকে দুর্বল বলেছেন।

৩. রাতে সূরা দুখান তেলাওয়াত: জুমার রাতে সূরা দুখান তেলাওয়াত করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার রাতে সূরা দুখান তেলাওয়াত করে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি, হাদিস: ২৮৮৯)

৪. ফজর নামাজে বিশেষ কিরাত: জুমার দিন ফজরের ফরজ নামাজের প্রথম রাকাতে সূরা সিজদা আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা দাহর তেলাওয়াত করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন ফজর নামাজের প্রথম রাকাতে আলিফ লাম মিম তানজিল (সূরা সিজদা) আর দ্বিতীয় রাকাতে হাল আতা আলাল ইনসানি হি-নুম মিনাদ দাহরি লাম ইয়াকুন শাইয়াম মাযকুরা (সূরা আদ-দাহর) তেলাওয়াত করতেন। (বুখারি, হাদিস: ৮৫১; মুসলিম, হাদিস: ২০৭২)

৫. সূরা আল কাহফ তেলাওয়াত: জুমার দিন সূরা আল কাহফ তেলাওয়াত করা। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, যে জুমার দিন সূরা আল কাহফ তেলাওয়াত করে তার জন্য ২ জুমার মধ্যবর্তী সময় বিশেষ আলো দ্বারা আলোকিত হয়। (সুনানুল-বায়হাকি আল-কুবরা, হাদিস: ৫৭৯২)

৬. কেয়ামতের ভয়াবহতা স্মরণ: জুমার দিন কেয়ামত সংঘটিত হবে। এ জন্য প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য দিনটিতে কেয়ামতের ভয়াবহতা স্মরণ করে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। আবু লুবাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) জুমার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে বলেন, জুমার দিন কেয়ামত সংঘটিত হবে। প্রত্যেক সম্মানিত ফেরেশতা, আকাশ, জমিন, বাতাস, পাহাড়-পর্বত ও সমুদ্র সব কিছুই জুমার দিন ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। (ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১০৮৪)

৭. দরুদ পাঠ: সকাল-বিকাল সময় করে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা উচিত। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিন তোমরা আমার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা এটি উপস্থিতির দিন। এদিনে ফেরেশতারা (আল্লাহর বিশেষ রহমত নিয়ে) উপস্থিত হয়। তোমাদের যে কেউই আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে তার দরুদ আমার কাছে পেশ করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত সে দরুদ থেকে অবসর না হয়। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম, মৃত্যুর পরেও কি দরুদ আপনার কাছে পেশ করা হবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, মৃত্যুর পরও দরুদ আমার কাছে পেশ করা হবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা নবীদের দেহ ভক্ষণ করা মাটির প্রতি হারাম করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর নবী সর্বদাই জীবিত, তাকে রিজিক দেওয়া হয়। (ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১৬৩৭)

৮. দান-সদকা: জুমার দিন সাধ্যমতো দান-সদকা করা উচিত। এদিনের দান-সদকা অন্যদিনের চেয়ে ফজিলতপূর্ণ। কা’ব (রা.) বলেন, আমি কি তোমাদের জুমার দিন সম্পর্কে বলব না? জুমার দিন দান-সদকা করা অন্যান্য দিনে দান-সদকা করার চেয়ে অতি উত্তম। [জাদুল মায়াদ ফি হাদয়ি খায়রিল ইবাদ (বৈরুত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪১৫ হি., ১৯৯৪ খ্রি.), পৃষ্ঠা-৪১২]

৯. পিতা-মাতার কবর জিয়ারত: পিতা-মাতা মারা গিয়ে থাকলে কমপক্ষে জুমার দিন তাদের কবর জিয়ারত করা উচিত। মুহাম্মদ ইবনে নুমান মারফু সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক জুমার দিন তার পিতা-মাতা অথবা কোনো একজনের কবর জিয়ারত করে তাকে ক্ষমা করা হয় এবং সে পিতা-মাতার আনুগত্যশীল হিসেবে পরিগণিত হয়। (শুআবুল ঈমান, হাদিস: ৭৯০১)

১০. আসর থেকে মাগরিব দোয়া-মোনাজাত: জুমার দিন একটি সময়ে আল্লাহ তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করে থাকেন। এ সময়টির ব্যাপারে বিভিন্ন মত থাকলেও বেশির ভাগের মতে—সময়টি আসর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। (দ্র. তিরমিজি, হাদিস: ৪৮৯)

সূর্যাস্তের মাধ্যমে জুমার দিনের সমাপ্তি ঘটে। কাজেই এই প্রান্তিক পর্যায়ে বেশি বেশি দোয়া, ইস্তিগফার এবং আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা খুবই জরুরি। যেন তা কবুল হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) জুমার দিনের আলোচনায় বলেছেন, জুমার দিন এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলমান বান্দা নামাজ অবস্থায় সে সময়টি লাভ করে এবং আল্লাহর কাছে কোনো কল্যাণ প্রার্থনা করে আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দান করেন। আর তিনি হাত দ্বারা সে সময়ের স্বল্পতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (বুখারি, হাদিস: ৯৩৫; মুসলিম, হাদিস: ৮৫২)

জুমার দিন আসরের পর থেকে মাগরিব নামাজের অপেক্ষায় থেকে মাগরিব পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও কল্যাণ প্রার্থনা করলে তা কবুলের আশা করা যায়।

ইয়া আল্লাহ! সব মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিনে আপনার নির্দেশকৃত আমলগুলো যথাযত ভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।