ইত্যাদিতে দেয়া রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাক্ষাৎকার ভাইরাল

প্রকাশিত: ১০:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৬, ২০১৯

বিনোদন ডেস্ক: তিন দশক পেরিয়ে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ এখন চার দশকের গোড়ায়। স্যাটেলাইটের চাকচিক্য আর আধুনিক নানামাত্রিক অনুষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এখনো তুমুল দর্শকপ্রিয়তা ধরে রেখেছে অনুষ্ঠানটি। এর উপস্থাপক হানিফ সংকেত এখনো দেশের সেরা উপস্থাপক।

গত ৪ অক্টোবর রাতে প্রচার হয় কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের হামিদ পল্লীতে ধারণ করা ‘ইত্যাদি’। প্রশংসিত পর্বটি বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে আজ রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর আবার প্রচার করা হবে।

এবারের পর্বে রয়েছে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিশেষ সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এটিই রাষ্ট্রপতির প্রথম সাক্ষাৎকার। সফল এই ব্যক্তিত্বের হাওরে বেড়ে ওঠার নানা স্মৃতিচারণ ও সাদামাটা সব আলাপচারিতার সেই সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়েছে।

মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে আবদুল হামিদের জন্ম। সেখানে কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার ফেলে আসা অতীতের অনেক গল্প। তিনি বলেছেন তার এলাকার মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা। তাদের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্কের কথা।

সাক্ষাৎকারটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

হানিফ সংকেত : মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমরা আমাদের এবারের অনুষ্ঠানটি করেছি আপনারই মিঠামইন উপজেলায়, যেখানে আপনার কেটেছে শৈশব এবং কৈশোর। তখনকার হাওর এবং এখনকার হাওর সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কী?
রাষ্ট্রপতি : আমি একেবারে ছোট সময় বর্ষাকালে হাওরের পানিতে সাঁতরানো, শুকনার সময় নদীতে সাঁতরানো, মাঠে-ঘাটে চরে বেড়ানো, একদম শৈশবে এগুলো আমি উপভোগ করেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার হাওরের যে চিত্র ছিল- বর্ষাকালে আমাদের কোনো লোক যদি মারা যেত তাকে দাফন করার জন্য কোনো গোরস্থান ছিল না, যার জন্য বর্ষাকালে কেউ মারা গেলে জানাজা পড়ে তাকে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হতো।

এগুলি আমার মনের মধ্যে একটা দাগ কাটত। রেয়ার বাড়িঘর ছিল যারা নাকি বাড়িতে কবর দিতে পারত এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এত অনগ্রসর ছিল এটা আপনি চিন্তাই করতে পারবেন না। এগুলি আমার মনে পীড়া দিত। যেমন আমার বাড়ি যে মিঠামইন উপজেলায়, সেখানে একটা হাইস্কুল ছিল। তখন আমি ভিপি, ছাত্র। সেই ছাত্রাবস্থায় ’৬৬ সালে আমি মিঠামইন হাইস্কুল করার উদ্যোগ নিই।

হানিফ সংকেত : আমরা শুনলাম আপনার এলাকায় আপনি শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
রাষ্ট্রপতি : শুধু মিঠামইন না, ইটনা, অষ্টগ্রামে আরও আছে।

হানিফ সংকেত : জি, এবং এত ব্যস্ততার মধ্যেও আপনি নিয়মিত প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁজখবর রাখেন।
রাষ্ট্রপতি : হ্যাঁ, খবর রাখি।

হানিফ সংকেত : এটা কী করে সম্ভব হয়?
রাষ্ট্রপতি : শোনেন, ব্যাপার হলো কী, সবকিছু আমি নিজে উদ্যোগ নিয়া করছি। তাই একটা মায়া-মমতা তো আছে।

হানিফ সংকেত : জি, জি।
রাষ্ট্রপতি : যার জন্য আমার এলাকায়, যখনই আমি যে অবস্থায় থাকি না কেন জনগণ থেকে কিন্তু আমি বিচ্ছিন্ন না। তারা আমার এখানে আসে। যখন আমি শুনি খারাপ একটা কিছু হচ্ছে তখন আমি ওই এলাকার ইউএনও বা জনপ্রতিনিধি যারা আছে তাদের বলি যে এই উদ্যোগটা নাও। সব সময় আমার মনে ছিল আমি সুযোগ পাইলেই আমার হাওর এলাকার কিছু ডেভেলপমেন্ট করব।

হানিফ সংকেত : আগে তো শুনেছি নাকি ওখানে রিকশা…
রাষ্ট্রপতি : রিকশা কি সাইকেল চালাবার রাস্তাও ছিল না। যখন প্রধানমন্ত্রী একবার ’৯৮-এ এখানে গেছিলেন তখন আমরা দুইটা রিকশা কিশোরগঞ্জ থেকে নিছিলাম। নৌকা করে মিঠামইন বাজারে নামাইয়া উনাকে তুইলা দুইটা রিকশা দিয়া চলেছি।

হানিফ সংকেত : অথচ ওখানে কিন্তু এখন গাড়িও চলছে।
রাষ্ট্রপতি : এখন সবকিছু চলে। এখানে হাওরের মধ্যে যে রাস্তা করার কথা আমি বলতাম পার্লামেন্টে, তখন সবাই হাসত। হাওরে আবার কীসের রাস্তা! তখন আমি সাবমার্জ রোডের কথা বললাম। এর পরই এগুলি শুরু হলো।

হানিফ সংকেত : হাওরে বিদ্যুৎ নেওয়াও তো কঠিন কাজ ছিল?
রাষ্ট্রপতি : ’৯৬-এ ক্ষমতায় আসার পর আমি ডেপুটি স্পিকার হইলাম, যখনই আমি এলাকায় গিয়া বললাম যে আমি হাওরে বিদ্যুৎ আনব তখন মাইনষে হাসাহাসি করে যে, ‘কইবার লাইগা কইছে, বিদ্যুৎ এই পানিতে কেমনে আনব?’ পরে ঠিকই আমি তিন উপজেলায় বিদ্যুৎ নিছি। ওই এলাকার মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন কোনো গ্রামই নাই।

হানিফ সংকেত : আপনি সাতবার মহান জাতীয় সংসদে প্রার্থী হয়ে প্রতিবারই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, এটি আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা বিরল দৃষ্টান্ত। এটা কীভাবে অর্জন করেছেন?

রাষ্ট্রপতি : আমাকে যে মানুষে ভোট দিছে, মানুষের একটা কনফিডেন্স ছিল মানুষ মনে করছে যে এই লোকরে ভোট দিলে আমার উপকারটা না করুক, আমার অন্তত অপকার করবে না।

হানিফ সংকেত : আপনি সংসদ সদস্য, মহান সংসদের স্পিকার থেকে আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সাফল্য এবং সম্মানের সর্বোচ্চ স্থানে গিয়েও আপনার ব্যক্তিত্বের এবং এলাকার মানুষের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বিষয়টি কী করে সম্ভব হচ্ছে?

রাষ্ট্রপতি : এই বঙ্গভবন সৃষ্টির পরে যতজন রাষ্ট্রপতি এখানে ছিলেন সমস্ত রাষ্ট্রপতি মিলাইয়া যে লোক না আসছে আমার এই কয়দিনে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লোক আসছে। কারণ এভরি উইকে মিনিমাম ফোর টু ফাইভ হানড্রেড লোক আমার এখানে আসেন এবং এর বেশির ভাগই কিশোরগঞ্জ এবং আমার এলাকার।

হানিফ সংকেত : জি, সেজন্যই সবাই বলে আপনি অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ।
রাষ্ট্রপতি : অনেকে এটাও বলে, স্যান্ডেল পরা রাষ্ট্রপতি।

হানিফ সংকেত : হা-হা-হা, মহামান্য রাষ্ট্রপতি- দেশের ভবিষ্যৎ জনপ্রতিনিধিদের প্রধান গুণ কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
রাষ্ট্রপতি : প্রথমত, তার সততা থাকতে হবে। জনগণের সঙ্গে যা বলবে মানে তারা কোন ফাঁকিবাজি করবে না। মানুষকে যা পারবে সে সেটা বলবে, যা পারবে না সেটা সে না করে দিবে। অর্থাৎ-

হানিফ সংকেত : মানুষকে আশা দেওয়ার দরকার নেই।
রাষ্ট্রপতি : মানুষকে মিথ্যা আশা দিয়া ঘোরানো ঠিক না। অনেক সময় দেখা গেল যে কেউ কাজের জন্য টেলিফোনে না ঘুরাইয়া টেলিফোন রিসিভার তুইল্লা টেলিফোনে বইলা দিছি, যাও। আসলে টেলিফোনই করে নাই।

হানিফ সংকেত : এতে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়।
রাষ্ট্রপতি : বিশ্বাস নষ্ট হইয়া যায় এবং অনেক সময় আমাদের দেশে এ ধরনের একটা কথা বলে, ‘তুই তো আমার লগে একটা পলিটিক্স করলি’। এখানে পলিটিক্সটাকে অন্য অর্থে ব্যবহার করেছে। সুতরাং পলিটিশিয়ানরা যদি সবাই সঠিকভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণ করে, কাজকর্ম সঠিকভাবে করে, ন্যায়-নিষ্ঠভাবে করে তাহলে ‘ওই আমার লগে পলিটিক্স করোস’, এই কথাটা আর কেউ বলত না। তখন পলিটিক্সটার প্রতি মানুষের একটা আস্থা, সম্মান, বিশ্বাস থাকত।

হানিফ সংকেত : এবার আমরা একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনি তো হাওর এলাকায় বড় হয়েছেন, হাওরে কখনো মাছ ধরার সুযোগ পেয়েছেন?
রাষ্ট্রপতি : আরে মাছ তো প্রচুর ধরেছি। বড়শি দিয়া মাছ ধরেছি। এবং আমার বড়শির মধ্যে বেশি মাছ ধরত না। তখন সঙ্গে যারা বসত যেই দেখছি অন্যে এইডা ধরছে তখন বড়শি টান দিয়া বদলাইয়া আমারটা তাকে দিয়া দিছি আর তারটা আমি তুইলা ফেলছি। এইসব করছি। তবে কোঁচ দিয়ে যে বড় মাছ শিকার করে, সেটা করিনি।

হানিফ সংকেত : সবশেষে একটু জানতে চাইব, আপনার এই শত ব্যস্ততার মধ্যে ‘ইত্যাদি’ দেখার মতো অবসর হয়?
রাষ্ট্রপতি : আরে বহুবার দেখি আমি ‘ইত্যাদি’। অনেক সময় মিস করলে, পয়লা দিন না দেখতে পারলে পুনঃপ্রচার যখন হয়, তখন দেখি।

হানিফ সংকেত : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আজকে আমাদের এই মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। আমরা আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
রাষ্ট্রপতি : এবং আপনারাও যে কষ্ট কইরা এখানে আসছেন এই হামিদপল্লীতে গিয়া যে আপনি ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠান করছেন আমি আবারও আপনাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই, ধন্যবাদ জানাই। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি সারা দেশবাসীকে, বিশেষ করে হাওরে এটা হইছে হাওরবাসীকেও আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই। এই ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের এবং আপনার সার্বিক সফলতা কামনা করি।

হানিফ সংকেত : অনেক ধন্যবাদ।

 

সৌজন্যে: জাগো নিউজ…