ধলাই ডেস্ক: বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট আকারের ডিম্বাকার বেগুনি কিংবা কালো রঙের থোকাথোকা ফল ঝুলছে। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে কালো আঙুরের বাগান হয়ত। বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়ক ধরে বরগুনা শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে সদর ইউনিয়নের হেউলিবুনিয়া এলাকা। সড়কের উত্তর দিকে তাকালেই নজরে আসবে শুধু মাঝারী সাইজের সাড়ি সাড়ি জাম গাছ।
খেতে হালকা টক আর মিষ্টি স্বাদের এই জাম ধরেছে আহসান হাবিবের বাগানে ৪৩টি গাছে। মৌসুমের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ টাকার জাম বিক্রি করেছেন তিনি। মৌসুম শেষে প্রায় ২০ লাখ টাকা আয় হবে আশাবাদ।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তরুণ হাবিব ভাগ্যান্বেষণে সুদূর কোরিয়া পাড়ি জমান। সেখানে কৃষি খামারে কাজ করেন। ২০০৬ সালে দেশে ফিরে আসেন হাবিব। কোরিয়া থেকে দেশে ফিরে গ্রামের বাড়ি হেউলীবুনিয়ায় হাঁস-মুরগী, মাছের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষের বাগান গড়ে তোলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। অনেক টাকা লোকসান হয়।
এরপর প্রায় ১০ একর জমিতে কোরিয়ান জাতের শতাধিক জাম চাড়া রোপণ করে তৈরি করেন জাম বাগান। বছর দুয়েক পরে গাছে ফুল ধরলেও জামের দেখা মিলছিল না। তাতে একটুও হতাশ হননি। উল্টো জাম গাছের পরিচর্যায় বেশি করে সময় দিত থাকেন। এবার সফল, মে মাসের শুরুতে গাছটি জামে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। জামে পুরো গাছই যেন ঢেকে যায়।
রোপণের তিন বছরের মাথায় ফল ধরতে শুরু করে। নষ্ট ও মারা যাওয়ার পর টিকে থাকে ৪৩টি গাছ। হাবিবের জাম বাগানে এবার ৪৩টি গাছেই জামের ফলন হয়েছে।
আহসান হাবিব বলেন, জামের বাগান তৈরির আইডিয়াটা আসে কোরিয়া থেকেই। হাঁস-মুরগীর খামারে ব্যর্থ হওয়ার পর চিন্তায় পড়ে যাই কি করা যায়। অনেক ভেবে চিন্তে জাম বাগান তৈরির পরিকল্পনা নেই। এরপর কোরিয়ান জাতের জামের বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করে সেই চারা বাগানে রোপণ করি। চারার পরিচর্যা করতে তিনবছর কেটে যায়। এখন আমার বাগানে ৪৩টি গাছে জামের ফলন ধরেছে।
তিনি আরো বলেন, বাজারে জামের বেশ চাহিদা। বরগুনার ও আশপাশের জেলার পাইকাররা বাগান থেকে জাম কিনে নিয়ে যায়। মৌসুমের শুরুতে ২শ করে কেজি বিক্রি করেছেন। এখনো ১৮০ টাকা করে পাইকাররা প্রতি কেজি জাম কিনে নিয়ে যান। এছাড়াও অনলাইনেও দেখেও অনেকে জাম ক্রয় করে নিয়ে যা।
হাবিব জানান, এখনো পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ টাকার জাম বিক্রি হয়েছে। এখনো গাছে যে পরিমাণ জাম রয়েছে বিক্রি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন হাবিব।
আহসান হাবিবের মেয়ে হুমায়রা আক্তার। বাবার কাজে তিনি সহযোগিতা করেন। তবে সেটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফেসবুকে প্রথম জাম নিয়ে পোস্ট দেন। মুহূর্তেই সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। প্রতিবেশীও সেই পোস্ট দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে ৪৩টি গাছে এত জাম!
হুমায়রা আক্তার বলেন, ফেসবুকের ফলেই জামের বিষয়টি সবার নজরে আসে। এমনকি ক্রেতাদের ৯৫ ভাগ অনলাইনে কিনছেন। কেউ কেউ অনলাইন ঘেঁটে জাম বাগান দেখতে আসনে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আকম মোস্তফা জামান বলেন, জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ মিলে প্রায় ২০ দিন খাওয়ার উপযুক্ত জাম পাওয়া যায়। ব্যবসায়িক উদ্যোগে উন্নত জাতের জাম বা হাইব্রিড জামের চাষ এই অঞ্চলে হয় না। তাই বাজারে পাওয়া জামের সবটাই দেশি জাতের। কিন্তু বরগুনায় যেটা হয়েছে এটি ব্যতিক্রম। এছাড়া কোথাও কোথাও কিছু থাই (থাইল্যান্ড) জামও দেখা যায়।
তিনি আরো বলেন, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী এবং গাজীপুরে জামের ফলন সবচেয়ে বেশি। এছাড়া প্রায় সব অঞ্চলেই কমবেশি জাম হয়। পুষ্টি ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ জাম সুস্বাদু খাবার। এখন সখ করে অনেকেই ছাদ বাগানে আমের পাশাপাশি জামও চাষ করেন। কিন্তু সেটা চার দেয়ালে বন্দী। বরগুনার চাষি আহসান হাবিবের দেখাদেখি আগামীতে অনেকেই হয়তো জাম চাষে এগিয়ে আসবেন।
হাবিবের জামের বাগানের দেখভাল করছে বরগুনার কৃষি বিভাগ। বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি জাম বিক্রিতে সহায়তা করেছে জেলা কৃষি বিভাগ।
বরগুনা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাম ওষধি জাতের একটি ফলদ বৃক্ষ, নানা প্রকার ওষধি গুণাগুণে সমৃদ্ধ জামের বিপুল চাহিদা রয়েছে বাজারে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জামের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও দক্ষিণে এখনো প্রসার ঘটেনি।
চারা উৎপাদন ও রোপণ থেকে থেকে শুরু করে আমরা আহসান হাবিবকে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। তিনি জামের ফলনে চমক দেখিয়েছেন। বরগুনায় এভাবে জাম চাষ করেও সফল হওয়া যে সম্ভব আহসান হাবিব সেটি প্রমাণ করেছেন। কেউ যদি এভাবে এগিয়ে আসে আমরা তার পাশে আছি।
সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…