ধলাই ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিটি বাহিনীকে সক্ষম করে গড়ে তুলছে। বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষায় আমাদের সক্ষমতা অর্জনের দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা প্রতিটি বাহিনীকে উপযুক্ত করে তৈরি করছি।
রোববার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা নেভাল এভিয়েশন হ্যাঙ্গারে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এভিয়েশন বহরে দুটি মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট এমপিএ-৮৩২২ ও এমপিএ-৮৩২৭ সংযোজন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সুশৃঙ্খল সশস্ত্রবাহিনী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বিপুলভাবে প্রশংসিত। ২০১০ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে আমাদের যুদ্ধ জাহাজ সার্বক্ষণিক অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া দক্ষিণ সুদানেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্ট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়াও এ বাহিনী নিয়মিত বহু জাতীয় এক্সারসাইজ, বঙ্গোপসাগরে কো-অর্ডিনেটেড পেট্রল ও কুটনৈতিক সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেরিটাইম সিকিউরিটিকে সুসংহত করে চলেছে। আমি এ কর্মমুখর নৌবাহিনীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
তিনি আরো বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নের পাশাপাশি সরকার দেশের অথনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের উন্নয়নের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলোও এখন হিমশিম খাচ্ছে। সেই অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। তবে আমরা নিজেদের সম্পদ দিয়েই দেশকে সুরক্ষিত রাখবো। যার যেখানে যতটুকু সুযোগ আছে আমাদের খাদ্য উৎপানে মনেযোগী হতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি সেখানে আন্তর্জাতিক মন্দার কিছুটা প্রভাব আমাদের ওপর পড়েছে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে এর থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকতে পারি। ব্লু ইকোনমির মাধ্যমেই আমরা সমুদ্র সম্পদকে অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে পারি। সেদিকেও আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। দেশে ব্লু-ইকোনমি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হয়েছে। এসকল কার্যক্রমের নিরাপত্তা ও নজরদারীতে নৌবাহিনীর এমপিএসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
’৯৭ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য ব্যারাক হাউজ করে দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প শুরু হয় উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের নৌবাহিনী মানুষের পাশে থাকে। এজন্য নৌবাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর থেকে আমরা জাতির পিতার প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়ন শুরু করি। বর্তমান সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট এবং সাবমেরিনসহ আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৭ সালে নৌ-বহরে ‘বানৌজা নবযাত্রা’ ও ‘বানৌজা জয়যাত্রা’ সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।
গভীর সমুদ্রে নজরদারী, উদ্ধার অভিযান ও অন্যান্য অপারেশনাল কার্যক্রমে এমপিএ’র কার্যকারিতা অপরিসীম উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এরই ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে পর্যায়ক্রমে দুটি অত্যাধুনিক ডর্নিয়ার ২২৮-এনজি মেরিটাইম প্রেট্রল এয়ারক্রাফট বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়। সূচনালগ্ন থেকে সুবিশাল সমুদ্রসীমা নজরদারির কাজ বাংলাদেশ নেভাল এভিয়েশনের এমপিএ স্কোয়াড্রন সর্বোচ্চ দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। সমুদ্রসীমায় নজরদারি বৃদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৭ সালে বর্তমান সরকার অতিরিক্ত দুটি এমপিএ ক্রয়ের কার্যক্রম গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় নৌবহরে আজ অত্যাধুনিক ডর্নিয়ার ২২৮-এনজি মেরিটাইম প্রেট্রল এয়ারক্রাফট সংযোজিত হলো। এর মাধ্যমে নেভাল এভিয়েশনের সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং স্বল্প সময়ে দ্রুততার সঙ্গে সুবিশাল সমুদ্রসীমা টহল প্রদান আরো সহজ হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড এরই মধ্যে পেট্রল ক্রাফট ও লার্জ পেট্রল ক্রাফট নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে যা দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘নির্মাতা নৌবাহিনী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদের নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু উল্লেখ করে নৌবাহিনীর সাহসী সদস্যদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ এর কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। তিনি একে আমাদের নৌযুদ্ধের ইতিহাসের ‘এক অনন্য বীরত্বগাঁথা’ বলেও উল্লেখ করেন। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুণর্গঠণে জাতির পিতার উদ্যোগের পাশাপাশি নৌবাহিনী পুণর্গঠন এবং বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণে সরকারের পদক্ষেপ সমূহ উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক অবস্থান এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র এলাকা ও তার সম্পদ রক্ষায় নৌবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার বিষয়টি সম্যকভাবে উপলদ্ধি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে একটি আধুনিক নৌবাহিনী গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তার ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল নৌবাহিনীর সদর দফতর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারত থেকে সংগৃহীত ২টি পেট্রল ক্রাফট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতা যুগোস্লাভিয়া ও ভারত থেকে পাঁচটি আধুনিক রণতরী সংগ্রহ করেন এবং ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ‘নেভাল এনসাইন’ দেন। একই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর বৃহত্তম প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বানৌজা ঈশাখাঁসহ ৩টি ঘাঁটি এবং ৩টি জাহাজ কমিশনিং করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে ‘দ্যা টেরিটরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন। যা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রনীতির ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব হয়েছে। ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিশাল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টি সবার জানা থাকলেও ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই বিশাল সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করা হবে।’ সেই ধারাবাহিকতায় আমরা ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নৌবাহিনীকে আধুনিক, দক্ষ ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, নৌ-বহরে যুদ্ধ জাহাজ সংগ্রহ এবং বিদ্যমান জাহাজসমূহের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধি, অপারেশনাল এভিয়েশন উইং গঠনসহ বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করি।
তিনি বলেন, সরকার এরই মধ্যে, এমপিএ ও হেলিকপ্টার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আধুনিক সকল সুবিধা সম্বলিত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা আরো বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন।
সরকার প্রধান বলেন, সাবমেরিন ও অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজকে পোতাশ্রয়ে নিরাপদ জেটি সুবিধা প্রদানে কক্সবাজারের পেকুয়াতে আধুনিক বেসিন সুবিধা সম্বলিত স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ নির্মাণের কাজ চলমান। এছাড়া এভিয়েশন সক্ষমতাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলবর্তী এলাকায় নৌবাহিনীর জাহাজসমূহের অপারেশনাল ও প্রশিক্ষণ সুবিধাসহ ‘বানৌজা শের-ই-বাংলা ঘাঁটি’ নির্মাণ কাজও অনেক দূর এগিয়েছে।
সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…