রোহিঙ্গাদের কারণে হুমকিতে টেকনাফ ও উখিয়ার জীবন-জীবিকা

প্রকাশিত: ৫:১১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২১
ফাইল ছবি

ধলাই ডেস্ক: মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ এখন রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন এ দুই উপজেলার স্থানীয়রা।

তারা বলছেন, আশ্রয় পাওয়ার পর বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমন আচরণ করছে যেন- তারাই এখানকার স্থানীয়। কৃষি জমি, স্থানীয় শ্রমবাজার চলে যাচ্ছে তাদের দখলে। এতে উখিয়া ও টেকনাফসহ আশপাশের স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে প্রথমদিকে যে মনোভাব স্থানীয়রা পোষণ করেছিল, এখন তা আর নেই। আশ্রয় নেয়ার চার বছর পরও তারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় টেকনাফ-উখিয়ার বাসিন্দারা হতাশ। ২০১৭ সালের আগস্টে ওই রোহিঙ্গা ঢলের সময় স্থানীয় যারা নিজ জমি ও বাড়িতে এসব মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা এখন নিজেদের জমিজমা হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন।

কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে দেখা গেছে, রিকশা, অটোরিকশা, মাহিন্দ্রসহ বিভিন্ন গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে, জেলেদের ফিশিং বোটে ও ব্যবসা বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কাজ এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফের স্থলবন্দরের অভ্যন্তরেও রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।

শুধু উখিয়া বা টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহরেও রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গারা স্বল্প বেতনে কাজ করে। তাই তারা রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কাজে নেন।

ক্যাম্পের বাইরে বের হওয়া প্রসঙ্গে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৪ এর বাসিন্দা আসমত উল্লাহ বলেন, অনেক রোহিঙ্গাই টমটম, রিকশা ও সিএনজি চালায়। এমনকি বন্দরেও কাজ করে। কাজ শেষে আবার ক্যাম্পে ফিরে যায়।

ক্যাম্প-২৬ এর রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইয়াকুব জানান, বাংলাদেশি মালিকের কাছ থেকে টমটম নিয়ে চালাচ্ছেন তিনি।

উখিয়ার পালংখালীর স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জমি, ক্ষেতের ফসল সব দখল করে নিয়েছে। সংরক্ষিত বনের পাশে দুই একর জমিই ছিল আমার জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এ জমিতে ধান ও সবজি চাষ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে ছিলাম। এখন রোহিঙ্গারা সেই সুখ কেড়ে নিয়েছে। দুই একর জমির পুরোটাই রোহিঙ্গাদের দখলে। আমার মতো আরো অনেকের জমি রোহিঙ্গারা দখলে নিয়েছে।

উখিয়ার জামতলা ক্যাম্পের মোড়ে মোড়ে বাজার। সেখানে মিলছে কাঁচাবাজার, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিকস পণ্য, জামা-কাপড়, জুতা, ওষুধ, জ্বালানি কাঠ, গ্যাসের সিলিন্ডার, দা-বটি-কুড়ালের মতো ধারালো অস্ত্রও। বাজার ঘুরে দেখা যায়, সেখানকার অন্তত ৪০ ভাগ পণ্য মিয়ানমারের। বাকি পণ্যের অর্ধেক বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ত্রাণসামগ্রী- যা নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় বিক্রির জন্য দোকানে তুলেছে রোহিঙ্গারা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে টেকনাফ ও উখিয়ায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। আগে যে সবজি ২০-৩০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। যাতায়াত খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে অটোরিকশা ভাড়া নিত ২৫০-৩০০ টাকা, এখন গুণতে হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকা। বাসেও দিতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।

সামগ্রিক বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের বিশাল জায়গা জুড়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রভাব স্থানীয়দের ওপর পড়েছে। একই সঙ্গে এসব এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকের কাজ করছে। রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে না আসতে পারে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমাদের বসতভিটা, ফসলের ক্ষেত, শ্রমবাজার- সব রোহিঙ্গাদের দখলে। আমার নিজের তিন একর জমিও রোহিঙ্গারা দখলে নিয়েছে। তাদের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুল-কলেজগুলোতে বিভিন্ন সংস্থার অফিস বসেছে। এছাড়া ক্যাম্পের বিভিন্ন এনজিও উচ্চ বেতনে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছে।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া উখিয়ার রাজাপালং ও পালংখালি ইউনিয়ন, টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নিলা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ লোক এখন চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা সহিংস হয়ে উঠছে। কথায় কথায় তারা স্থানীয় লোকজনের ওপর চড়াও হয়। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ করলেও তাদের পুলিশে দেওয়া যায় না। তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন স্থানীয়রা।

ক্যাম্পের ভেতরে বাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পে কোনো ধরনের বাজার স্থাপনের অনুমতি নেই। আমরা এরই মধ্যে কয়েকটি বাজার উচ্ছেদ করেছি। পর্যায়ক্রমে সবগুলো উচ্ছেদ করব।

সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…