ধর্ম ডেস্ক: মানুষের মন্দ স্বভাবের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। এজন্য তাদের শাস্তিও হবে কঠোর। ওরা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ওদেরকে অপমান করার জন্য হাশর ময়দানে প্রত্যেকের পিছনে বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা ওড়িয়ে দেয়া হবে। হাশরবাসী দেখে বুঝতে পারবে যে, ওরা দুনিয়ায় স্বজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
নিম্নে এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের বর্ণনাগুলো তুলে ধরা হলো-
বিশ্বাসঘাতকের বিরুদ্ধে আল্লাহর অভিযোগ উত্থাপন
হাশর ময়দানের ভয়াবহতা সম্পর্কে সব মুসলমান অবগত। আল্লাহ হলেন সে দিনের মালিক। তার ছায়া ব্যতিত কোন ছায়া থাকবে না। কিন্তু কতই না দুর্ভাগ্য ওদের স্বয়ং আল্লাহ যাদের বিরুদ্ধে ওই দিন অভিযোগ উত্থাপন করবেন। হ্যাঁ, যাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা অভিযোগ করবেন তাদের মাঝে প্রথম হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক শ্রেণি।
সহীহ বুখারীতে এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হাশর ময়দানে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। এক. ওই সব লোক যারা আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা দিয়ে গাদ্দারি করেছে। দ্বিতীয়. যারা স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে মূল্য আত্মসাৎ করেছে। তৃতীয়. যারা কোনো ব্যক্তিকে ভাড়ায় খাটিয়ে তার পারিশ্রমিক আদায় করে না। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২২৭০)
আল্লাহ তায়ালা সব জালেম ও অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তারপরও এই তিন শ্রেণির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এ তিন শ্রেণির অপরাধ আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে ওয়াদা দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে দুনিয়াতে জীবন যাপন করার ব্যাপারে উর্ধ্ব জগতের ওয়াদা। সেখানে আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তখন মানুষ বলেছিলো হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রভু। যারা এই ওয়াদা ভঙ্গ করে নিজের খায়েশাতের অনুগামী হয়ে জীবন যাপন করে আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবেন।
মানব পাচার করে অর্থ উপার্জনের পরিণতি
আল্লাহ তায়ালা হাশর ময়দানে দ্বিতীয় যে শ্রেণিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবেন তারা হচ্ছে যারা স্বাধীন মানুষকে ধরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। কাজটি এতই অমানবিক যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই শ্রেণির বিপক্ষে দাঁড়াবেন। স্বাধীন মানুষ ও দাসের মাঝে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে দাসের কোন এখতিয়ার থাকে না। বর্তমান সময়ে দাস হিসেবে মানুষ বিক্রির প্রচলন নেই। বাজারগুলোতে দাস বিক্রির হাট বসে না। তবে দাস হিসেবে বিক্রির আধুনিক সংস্করণ ধরা যায় মানব পাচারকে। নারী, শিশু ও উপযুক্ত বয়সের মানুষকেও বিক্রি করে দেয়া হয় ভিনদেশী মানুষের কাছে। ওরা পাচারকৃতদের সব এখতিয়ার রহিত করে হাতের পুতুলের মতো ব্যবহার করে। তাই রাসূল (সা.) এর হাদিসের বাস্তবতা বর্তমান সময়ে দেখতে চাইলে মানব পাচারকারীদের দেখতে হবে। তৃতীয় যে শ্রেণিটির বিরুদ্ধে আল্লাহর অভিযোগ উত্থাপন হবে তারা হচ্ছে মানুষকে খাটিয়ে যারা পারিশ্রমিক দেয় না। তাই ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।
বিশ্বসঘাতকতা খেয়ানত ও মিথ্যার সংমিশ্রনে ঘটিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বাসঘাতকতার মাঝে মৌলিক দুটি উপাদান পাওয়া যায়। উভয়টি গুনাহ ও মন্দ স্বভাবের অন্তর্ভূক্ত। ইসলামের নির্দেশ হলো অন্তরে যে বিশ্বাস পোষণ করা হয় মুখেও তাই বলা। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকায় মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ ও চিন্তার মাঝে মিল থাকে না। বরং তারা মুখে বলে এক কথা আর অন্তরে পোষণ করে অন্য কথা। ইসলামি পরিভাষায় এ ধরনের আচরণকে মুনাফেকি বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকের হাকিকত প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘যখন মুনাফিকরা আপনার নিকট আসে, ওরা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল… আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওই মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী (কারণ ওদের কথা ও অন্তরের বিশ্বাসের মাঝে মিল নেই)।’
(সূরা মুনাফিকুন, আয়াত নং-১) রাসূল (সা.) বলেন, মুনাফিকের আলামত চারটি। আমানত রাখলে খেয়ানত করা, মিথ্যা কথা বলা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ও ঝগড়ার সময় গালাগালি করা।’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-) হাদিসে উল্লেখিত প্রত্যেকটি বিষয়েই মানুষের ভিতরগত অবস্থা ও বাহ্যিক আচরণের মাঝে মিল না থাকায় মুনাফিকের আলামত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এটাই বিশ্বাসঘাতকতা। মুনাফিকিতে দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে মিথ্যার আশ্রয়। হাদিসে এসেছে মিথ্যা হলো গর্হিত কাজ। আর সব গর্হিত কাজ মানুষকে জাহান্নামের পথ ধাবিত করে।
হাশরের মাঠে প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের পেছনে ঝান্ডা ওড়িয়ে দেয়া হবে
বিশ্বাসঘাতকরা সবচেয়ে বেশি অপমানিত হবে হাশরের মাঠে। তাদের অপকর্মকে মানব জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে পতাকার ব্যবস্থা করা হবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমের এক হাদিসে পাওয়া যায়, নবী করিম (সা.) বলেন, প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য কিয়ামত দিবসে আলাদা আলাদা ঝান্ডা থাকবে। বলা হবে এটা ওমুকের বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা। ঝান্ডা মূলত ব্যবহার হয় পরিচয়ের জন্য। প্রত্যেক জাতির ঝান্ডা ওই জাতির সংস্কৃতি ও চেতনা বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্বাসঘাতকের ঝান্ডা মূলত তার সংস্কৃতি ও চেতনা বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করবে।
সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক সবচেয়ে বড় ঝান্ডা
হাশর ময়দানে বিশ্বাসঘাতকতার মাত্রা অনুযায়ী ঝান্ডা উঁচু নিচু হবে। যে যত বড় বিশ্বাসঘাতক তার ঝান্ডা তত বড়। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার চেয়ে একটা জাতি বিশ্বাসঘাতকাতর শিকার হওয়ার বিপর্যয় অনেক বড়। তাই সবচেয়ে বড় ঝান্ডা হবে ওই ব্যক্তির যার উপর জনগণের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়, কিন্তু সে তা পালন না করে বিশ্বাসঘাতকতা করে। হজরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেন, প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের পেছনে বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা ওড়ানো হবে। জেনে রেখো! সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত আমীরের চেয়ে বড় কোন বিশ্বাসঘাতক নেই।’ (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-৪৫১৩)
সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন। বর্তমানে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্রতিশ্রæতি দিয়ে থাকেন। পরে তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। বরং অনেকে জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে থাকেন। রাসূল (সা.) তাদেরকে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক বলেছেন কারণ, তারা মানুষের প্রয়োজন ও আশা পূরণে বেশি সক্ষম। তাই মানুষের আশা-ভরসা তাদেরকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে। তাছাড়া তাদের সঙ্গে বহু মানুষের সংশ্লিষ্টতা থাকে। তাই তাদের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি ভোগ করতে হয় বেশি মানুষকে।
তবে উক্ত হাদিস থেকে হজরত ইবনে উমর (রা.) ব্যাপক অর্থ উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
অর্থাৎ আমীরদের বিশ্বাসঘাতকতা যেমন বড় তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে জনগণের বিশ্বাসঘাতকাও অনেক বড়। তাই আমীরের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তার ঝান্ডাও অনেক বড় হবে। তখন সাধারণ মানুষের তরফ থেকে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের বৈধ বিধান লংঘন করাও এই হাদিসের অন্তর্ভূক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফের ফেতনা সংক্রান্ত বিষয়ের অধ্যায়ে এসেছে, যখন মদীনাবাসী ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বাইয়াতকে ভেঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন হজরত ইবনে উমর (রা.) নিজের শুভাকাঙ্খী ও সন্তানাদিকে একত্রিত করে বলেন, আমি রাসূল (সা.) থেকে শুনেছি ‘কেয়ামতের দিন প্রত্যেক গাদ্দারের পেছনে একটি করে ঝান্ডা থাকবে।’আমি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার হাতে আল্লাহ ও রাসুলের নামে বাইয়াত হয়েছি। আমার মতে কোন ব্যক্তির হাতে বাইয়াত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করার চেয়ে বড় কোন গাদ্দারি হতে পারে না।’ (সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল মুলহিম খন্ড-৯, পৃষ্ঠা-২৫)
হজরত সুলাইমান ইবনে আমের বলেন, রোমের সঙ্গে হজরত মুআবিয়া (রা.) এর একটি সন্ধিচূক্তি ছিলো। চূক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি রোমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান, যেন মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই দুশমনের উপর হামলা করতে পারেন। তখন তাকবির দিতে দিতে এক লোক সামনে এগিয়ে এসে বলেন, ‘চূক্তির মেয়াদ পূর্ণ করো, গাদ্দারি করো না।’ ঘোষণাকারী ছিলেন বিখ্যাত সাহাবি আমের ইবনে আবাসা (রা.)। তিনি হজরত মুয়াবিয়াকে বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে চূক্তি থাকলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে থাকা যাবে না। অন্যথায় বিরোধীদেরকেও বিষয়টি জানিয়ে দিতে হয়, যেন উভয়ের অবস্থা সমান থাকে।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-২৭৫৯) এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। শুধু স্বজাতির সঙ্গে গাদ্দারি করা গর্হিত কাজ এমন নয় বরং অমুসলিমদের সঙ্গে গাদ্দারি করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ইসলাম একদিকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি বর্ণনা করেছে। অন্যদিকে বিশ্বস্ততা ও মানুষের সঙ্গে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত নং-১) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘অঙ্গীকার পূর্ণ করো। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (সূরা ইসরা, আয়াত নং-৩৪) অঙ্গীকার পূর্ণ করাকে ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(মুমিন হচ্ছে) যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রæতি রক্ষা করে।’ (সূরা মাআরিজ, আয়াত নং-৩২)
বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডার কালার
আরবরা তাদের বিভিন্ন সমাগমে গাদ্দারি ও বিশ্বস্ততার ঝান্ডা ওড়িয়ে দিতো। যেন বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি মানুষ নিন্দা জ্ঞাপন করতে পারে। ওই সময় বিশ্বস্ততার ঝান্ডার কালার হতো সাদা আর বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা হতো কালো রঙের। তাই বলা যায় হাশরের ময়দানেও বিশ্বাসঘাতকদের ঝান্ডার কালার হবে কালো যেমনটি অনেক মুহাদ্দিস মনে করেছেন।
ইসলাম বিশ্বাসঘাতকতা ও গাদ্দারি সম্পর্কে এত কঠোর হুমকি দেয়া সত্ত্বেও সম্ভবত মুসলমানের মাঝেই বর্তমানে গাদ্দারের সংখ্যা বেশি। এর কারণও স্পষ্ট। আমরা অনেক কিছু বলি কিন্তু কাজে বাস্তবায়ন করি না। অথচ কথা ও কাজে মিল রেখে চলাই খাঁটি মুমিনের আলামত।
সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…