হাসন রাজাসহ সিলেটের জমিদারদের আড্ডা বসত এ বাড়িতে

প্রকাশিত: ৫:০৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৫, ২০২১

ধলাই ডেস্ক: আট একর জায়গাজুড়ে বিশাল পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে তাকালে ভেসে ওঠে দৃষ্টিনন্দন মসজিদের পিলার ও গম্ভুজের প্রতিচ্ছবি। এই মসজিদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আসাম প্যাটার্নের ১৩ চালা টিনের ঘর। কাঠ-বাঁশের খানার ওপর চুনসুরকি ব্যবহৃত ঘরটিতে রয়েছে নানা কারুকার্য। এর পাশেই শুধুমাত্র ইট ও কাঠ দিয়ে তৈরি বিশাল বিচারালয়।

১৭ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত এই প্রাচীন স্থাপনাটি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের চারিগ্রামে অবস্থিত সাজিদ রাজার বাড়ি। স্থানীয়দের দাবি, এখানেই এক সময় হাসন রাজাসহ সিলেটের জমিদারদের আড্ডা বসত।

সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত বাড়িটি সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অংশ। অযত্ন, অবহেলায় ইতিহাসের সাক্ষী হ্যে থাকা বাড়িটি আজ ধ্বংসের পথে। তবে পরিত্যক্ত অবস্থায় থেকেও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছে ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনা। এ কারণে প্রতিদিনই দূর-দুরান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন বাড়িটি দেখতে।

রাজবাড়ির দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

রাজবাড়ির দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

জানা গেছে, ১৭ শতকের প্রথম দিকে জকিগঞ্জ উপজেলা ও এর আশপাশ শাসন করতেন জমিদার সাজিদ রাজা। প্রজাদের দেখভাল করার জন্য কাঠের তৈরি গাড়ি ও হাতির উপর চড়ে রাজ্য ঘুরে বেড়াতেন। ব্যক্তি জীবনে রাজা ছিলেন চিরকুমার। তার রাজবাড়ি ছিল প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে। এই বাড়িতে রয়েছে ১৩ চালার একটি টিনের ঘর। ব্রিটিশ আমলে জমিদার সাজিদ রাজার বোনের উত্তরাধিকারীরা শখের বশে এই ঘর তৈরি করেন। তৎকালীন ১৩ হাজার টাকায় কলকাতার মিস্ত্রিরা ১৩টি চাল তৈরি করেন।

এছাড়া সাজিদ রাজা ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে তার বাড়ির সামনে পিলার ও গম্ভুজের সমন্বয়ে দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সাধারণ মানুষের পানির জন্য বাড়ির সামনে প্রায় আট একর জায়গা জুড়ে একটি বিশাল পুকুর খনন করেন। প্রজারা সেই পুকুরের পানি খেয়ে তৃঞা নিবারণ করতেন। আজও সেই পুকুরের পানি ব্যবহার করেন রাজবাড়ির আশপাশের মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো রাজবাড়িটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় দখল করে নিয়েছে সেই ১৩ চালার টিনের ঘর। অযত্ন অবহেলার চিহ্ন নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে রাজার সেই বিচারালয়। তবু আজও ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়ে নেয় প্রাচীন এই স্থাপনা। এক অমোঘ টানে প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা।

রাজবাড়ির বিচারালয়

রাজবাড়ির বিচারালয়

বর্তমানে জমিদার সাজিদ রাজার বংশের কেউ এ বাড়িতে থাকেন না। সবাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আছেন। অনেকে আবার বিদেশেও চলে  গেছেন। শুধুমাত্র রাজার বোনের বংশদ্ভূতদের মধ্যে সারোয়ার হোসেন চৌধুরী নামে একজন বাড়িতে অবস্থান করছেন। ব্যক্তিজীবনে জীবনে তিনিও রাজার মতোই চিরকুমার।

সারোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, এই অঞ্চল একমাত্র সাজিদ রাজাই শাসন করতেন। তার দানকৃত জায়গায় গড়ে উঠেছে আটগ্রাম বাজার, ইউনিয়ন হাসপাতাল, ডাকবাংলো, মাদরাসা, স্কুল, রাস্তাঘাট। বাড়িতে কেউ না থাকায় পুরোনো এই স্থাপনাগুলো অবহেলিত হয়ে আছে।

তিনি আরো বলেন, ১৮৩৬ সালে ভূমিকম্পে রাজার বিচারালয়ের একটি অংশ ধসে পড়ে। পরে আমরা এটি সংস্কার করি। এছাড়া গত বছর পুরোনো মসজিদটি রং করা হয়েছে। এই মসজিদে স্থানীয়রা নামাজ পড়েন। রাজার সময়ে খনন করা সেই পুকুরে এখনো মানুষ গোসল করে, পানি পান করে। রাজা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন।

প্রজাদের জন্য সাজিদ রাজার খনন করা বিশাল পুকুর

প্রজাদের জন্য সাজিদ রাজার খনন করা বিশাল পুকুর

সারোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই আসেন রাজার বাড়ি দেখতে। উদ্যোগ নিলে এসব পুরোনো স্থাপনা রক্ষা করা যেতে পারে। রাজার ইতিহাস ও স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন স্থাপনা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে। এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর প্রধান সমন্বয়ক গবেষক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, আমি এই প্রাচীনতম স্থাপনা ঘুরে দেখেছি। এটি আমাদের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। অবিলম্বে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক এটিকে সংরক্ষণ করা উচিত। এছাড়া এ বাড়িকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সাজিদ রাজা সম্পর্কে মানুষ আরো জানতে পারবে। আমদের এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাজিদ রাজার বোনের বংশোদ্ভুত ও সিলেটের মতিন উদ্দিন আহমদ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা শাহজামান বলেন, ১৭ শতকের শুরুর দিকে জমিদার সাজিদ রাজা এই অঞ্চলে শাসন করতেন। রাজা চিরকুমার থাকায় তার বিশাল সম্পত্তি চার ভাগনের মধ্যে বন্টন করে দেন। এই প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সঙ্গে সাজিদ রাজার অনেক স্মৃতি রয়েছে। ৪০০ বছরের পুরোনো এসব স্থাপনা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ…