ধলাই ডেস্ক: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চলছে রমরমা মহাজনী সুদের ব্যবসা। প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা সুদ দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। মাস শেষে সুদের টাকা দিতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বৃদ্ধি পায়। সুদ ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এরই মধ্যে অনেকে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। সুদের ব্যবসা কয়েক বছর ধরে চলছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে। সমাজের কিছু মুখোশধারীরা কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে অনেক মানুষের সাথে সম্পর্ক করে নিজের নাম আড়াল করে। অন্যের নামে স্ট্যাম্প করে এখন চলছে অর্থলগ্নির রমরমা ব্যবসা। এর কারণে সমাজ এবং পরিবারের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ব্রিটিশ আমলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করে বাংলার কৃষকদেরকে সুদখোর মহাজনদের শোষণ থেকে রক্ষা করেছিলেন। পরে আবার গোপনে সুদখোর মহাজনরা এ ঘৃণ্য ব্যবসা শুরু করে। কমলগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে এ ব্যবসা জমজমাট। এরা মানুষের কাছ থেকে অস্বাভাবিক চড়া সুদ আদায় করছে। এদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এছাড়াও এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার, মুন্সীবাজার, শমশেরনগর, আদমপুর, আলীনগর, মাধবপুর, কমলগঞ্জ সদরসহ সবকটি ইউনিয়ন ও আনাচে জকানাচে এক শ্রেণির অসাধু দাদন ব্যবসায়ী চড়া সুদে কৃষকদের ঋণ প্রদান করছে। এসব দাদন ব্যবসায়ীরা সুদের ব্যবসা চালিয়ে দ্রুত ধনী হয়ে উঠছে। পাশাপাশি এনজিওর মহাজনী ঋণের কিস্তি চালাতে নিঃশেষ হচ্ছে পরিবারস্তুহ। এনজিওর ঋণ গ্রহণকারী আবুল মিয়া জানান, ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাজে লাগানোর পূর্বেই ঐ টাকা ভেঙে সপ্তাহের কিস্তি চালাতে হয়। ফলে সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে গিয়ে টাকা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না এবং ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে।
কমলগঞ্জ উপজেলার নিম্নবিত্ত প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার এনজিও এবং মহাজনী ব্যবসায়ীদের ঋণের জালে আটকা পড়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। এছাড়াও এনজিও আর দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও ঋণ গ্রহণ করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব ঋণ গ্রহণ করে কেউ মুখ খুলে কথাও বলতে পারছেন না। অভাব-অনটনের সংসারে অশান্তি, অস্থিরতা, হতাশা ও ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে।
শমশেরনগর চা-বাগানের বাসিন্দা সুমন চাষা বলেন, দৈনিক যা রোজগার করি তা এনজিওর কিস্তি পরিশোধে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পতনঊষার ইউনিয়নের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মনাই মিয়া বলেন, আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে মাসিক শতকরা দশ টাকা হার সুদে টাকা নিয়ে পরে মাসের পর মাস ঋণ পরিশোধ করেও সুদে-আসলে টাকা শেষ হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লক্ষীপুর গ্রামের একজন কৃষক জানান, মুন্সীবাজার এলাকার এক প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ঋণ এনে এক বছরে দ্বিগুণ টাকা দিয়েও ঋণ পরিশোধ হয়নি। ফলে নি:স্ব হয়ে পড়ছেন তার পরিবার।
স্থানীয় কৃষকরা বলেন, কৃষি শ্রমিকের মজুরি, সার-ডিজেল-কীটনাশক, বীজের মূল্য পরিশোধ করে চাষাবাদের পর উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঋণগ্রস্ত হতে হয়। এছাড়াও বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পর তা কাটিয়ে উঠতে না পেরে এনজিও, দাদন ও মহাজনী ব্যবসায়ীদের ঋণের জালে আটকা পড়েছি।
শমশেরনগর ইউনিয়নের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘প্রয়োজনের তাগিদে আমার মা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সপ্তাহে কিস্তি চালাতে হিমশিম খেতো। ঋণ থাকাকালীন সাংসারিক খরচাদিসহ মাছ, মাংস কিনে খাওয়ারও সাধ্য ছিল না। এভাবে এখন নিম্নবিত্ত শত শত পরিবার এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের কবলে আটকা পড়ে চরম অভাব-অনটনে দিন কাটাতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা যায়, সুদখোর মহাজনরা ঋণ দান করে মাসিক শতকরা ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত সুদ আদায় করছে। এরা পাঁচ দশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে চার পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে।
রহিমপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার প্রদীপ আচার্য্য বলেন, আমার ছোট ভাই প্রণয় আচার্য্য সুদখোর মহাজনের জ্বালায় প্রায় দুই মাস ধরে পরিবার সদস্যদের কাছ থেকে বাড়ি ছাড়া। এ পর্যন্ত তিনি ছোট ভাইয়ের ঋণ বাবদ বিভিন্ন মহাজনদের সুদের লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করেছেন। ঋণ দানকালে এরা ঋণ গ্রহণকারীর কাছ থেকে ব্যাংকের খালি পাতার চেকে সই নিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি কেই কেউ সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে থাকে। টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্য্যংক চেকের পাতায় ইচ্ছামত অংক বসিয়ে নেয়। তারপর মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখিয়ে চাপ দিতে থাকে।
অনেক পরিবার একাধিক এনজিওর ঋণে জর্জরিত। একটির কিস্তি পরিশোধ করতে না করতেই অন্যটির টাকা জোগাড় করতে হয়। ফলে ঋণ গ্রহীতাদের দাদন ব্যবসায়ীর দ্বারস্থ হতে হয়। মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ বা কমমূল্যে আগাম ফসল বিক্রি করে টাকা নিয়ে এনজিওর কিস্তি দিতে হয়। এমনিভাবে তাদের ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়ে চলছে। এক ঋণ থেকে বাঁচতে অন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে তারা। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গৃহবধূর স্বর্ণালঙ্কার, হালের পশু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেও পার পাচ্ছে না অনেক পরিবার। শেষ সম্বল বাপ-দাদার বসতভিটাও বিক্রি করেছেন অনেকে। এনজিওর ঋণের চাপে সমবায় সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও এখন জমজমাট।
মহাজনী সুদের কারণে অনেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অনেকে পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে প্রশাসন কাজ করা উচিত। ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমজমাটভাবে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সুদখোররা। এছাড়া বিভিন্ন ভুঁইফোড় সমিতি ও এনজিওর নামে দাদন ব্যবসা চালিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
আলাপকালে কমলগঞ্জের লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ অভাব অনটন, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষির অনগ্রসরতা এসব নানা কারণেই দরিদ্রতার ঘেরাটোপে প্রায়শই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের আশ্রয় নিতে হয়। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিম্ন আয়ের মানুষের এমনিতেই চুলো জ্বলছে না। এর ওপর মহাজনী সুদসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি শোধের চাপে দিশেহারা এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানের নি¤œ আয়ের মানুষগুলো। ইতোমধ্যেই এনজিও ঋনের টাকা পরিশোধে অনেকে শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছেন।
শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম আকনজী বলেন, সুদ ব্যবসায়ীরা বেপরোয়ার কথাটি শুনেছি। এছাড়া সুদ ব্যবসার টাকার জন্য কারও বাড়ি, এমনকি ব্যাংকে চেক রেখেছে- এমন ঘটনা যদি কেউ থানায় অভিযোগ করে তাহলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জয়নাল আবেদীন বলেন, এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।