শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক: মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার ৷ এই দাবিতে রক্ত ঝরেছিল ৷ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকহ নাম না জানা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার এই মহান ঘটনাকে সারা বিশ্ব এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ৷ ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। মাতৃভাষা অর্থ মায়ের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে আমরা যে ভাষা শিখি তাই হলো মাতৃভাষা (Mother Language)। অর্থাৎ, মানুষ জন্মের পর সাধারণত প্রথমে তার মায়ের কাছে লালিত-পালিত হয়, তারই কথা শেখে। তাই জন্মলগ্ন থেকে স্বাভাবিকভাবে মানুষ নিজের মায়ের কাছে যে শিক্ষা পায়, তাকেই তার মাতৃভাষা বলে। মায়ের মুখনিঃসৃত ভাষাকেই মাতৃভাষা বলা হয়।” মাতৃভাষার এই সংজ্ঞাটি রাষ্ট্রভাষায় দেয়া আছে। রাষ্ট্রভাষা মূলত লিখিত ভাষা যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় যাবতীয় কর্মকাণ্ড সাধিত হয়। আমাদের বোঝার সুবিধার্থে এই সংজ্ঞাটিকে যদি আরেকটু সহজ করে বলা যায়। তাহলে সংজ্ঞাটি দাঁড়ায় “মায়ের মুখের কথাই মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন।’ চিন্তার দিক থেকে আমাদের হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক, কিন্তু পরিচয়ে থাকতে হবে বাঙালিয়ানার সুস্পষ্ট ছাপ। বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার প্রত্যয় প্রত্যেক বাঙালির অন্তরে থাকা প্রয়োজন। আজ আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করি। স্বাধীনতার পিছনে যেসব প্রধান কারণ রয়েছে,তার অন্যতম একটি হচ্ছে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আমাদের বাক স্বাধীনতা খর্ব করতে চেয়েছিল৷ মরিয়া হয়ে উঠেছিল উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। তাদের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে বাঙালী বাংলাভাষা – ভাষীরা গড়ে তুলেন তীব্র আন্দোলন। কিন্তু বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুলেন রাজপথ। কিছু মানুষ শুদ্ধ বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে যেন তৃপ্তি পেয়ে থাকেন। এটা মাতৃভাষার জন্য বড়ই বেমানান। বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ভাষার ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার প্রভৃতি। বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। ওই নির্দেশে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ ভাষাদূষণ ও বিকৃতি রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ৯ দফা সুপারিশও করে। বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।হাইকোর্টই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর আদেশ দেন ২০১৪ সালে। রয়েছে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭সহ সরকারি অনেক বিধিনিষেধ। ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের ভাষা শহীদদের। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সেই দিনে বাঙ্গালিদের আত্মত্যাগ যথার্থই অতুলনীয়।
আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত আমাদের মাতৃভাষার জন্য। শহীদরা আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের সম্মানজনক স্থানে। সার্থক হয়েছে তাঁদের রক্তদান। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য। সবার অন্তরে হোক মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাস। মহান ভাষা আন্দোলনে বীর শহীদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
নির্মল এস পলাশ, সাংবাদিক, সমাজকর্মী।