নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ঝুলন চক্রবর্তী, ছাত্র পড়িয়ে তিন দশক পার

প্রকাশিত: ১:১০ পূর্বাহ্ণ, মে ১২, ২০২০

কমলগঞ্জ সংবাদদাতা: একজন অদম্য সাহসী মধ্যবয়সী যুবক তার মেধাকে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন আগামী প্রজন্মকে সঠিক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলতে। সেই মানুষ গড়ার কারিগরটি আর কেউ নন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ কালীবাড়ীর ঝুলন চক্রবর্তী।

কলের কাছে ঝুলন স্যার নামেই তিনি সর্বধিক পরিচিত। উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা (স্নাতক ডিগ্রি) থাকা সত্বেও তিনি সরকারি বা বেসরকারি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরি গ্রহণ না করেও শিক্ষাকে জীবনের ব্রত করেছেন। ছাত্র পড়ানোকে জীবনের সঙ্গী করেছেন।

অদম্য মেধাবী এই ব্যক্তি ছাত্র জীবনে লেখাপড়ার ফাঁকে বাড়তি উপার্জনের জন্য গৃহ শিক্ষকের কাজ করতেন। কিন্তু তিনি কি তখন জানতেন একদিন এটাই হয়ে উঠবে তার একমাত্র নেশা ও পেশা। অবশ্য তিনি শিক্ষা জীবন শেষে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হবার একবার ইচ্ছা পোষণ করে ১৮০০ প্রতিযোগীর মধ্যে মেধা তালিকায় উর্ত্তীণ হয়েও পরে কেন চাকরিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলেন না তা আর তলিয়ে দেখতে যাননি। জীবিকার তাগিদে তিনি বেঁছে নেন শিক্ষকতা পেশাকে।

ছাত্র পড়ানোই যেহেতু তার লক্ষ্য তখন তিনি আর ডান বাম না চেয়ে এ কাজেই নিবিষ্ট হয়ে পড়েন। নিজ বাসভবনেই শুরু করেন ছাত্র পড়ানোর কাজটি। কমলগঞ্জ উপজেলা সদরের পৌর এলাকার পানিশালা গ্রামে বসবাসকারী মানুষ গড়ার কারিগর ঝুলন চক্রবর্তী ১৯৮৭ সনে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় ৩/৪ জন ছাত্রকে নিয়ে “ চক্রবর্তী প্রাইভেট কোচিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন । তার নিরলস চেষ্টায় ছাত্রদের সকলেই যখন এসএসসি পরীক্ষায় লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগ পেলো। তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। এরপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

রোজগারের বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষাদানের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণে প্রতিবছরই তার কোচিং সেন্টারে শিক্ষা নেয়া ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করছে। এখানে শিক্ষা নেয়া ছাত্রদের অনেকেই আজ ডাক্তার, ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় প্রতিবছর পাসের হার শতভাগ হওয়ায় উত্তরোত্তর বাড়ছে ছাত্র সংখ্যা। বর্তমানে এই কোচিং সেন্টারের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭০ জন। প্রতি ব্যাচে ১৫ জন করে ছাত্রকে শিক্ষাদান করা হয়। প্রধান পরিচালক ঝুলন চক্রবর্তী ছাড়াও আরও ৪ জন মেধাবী শিক্ষক নিয়মিত পাঠদান করছেন শিক্ষার্থীদের। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত তার ছাত্র তালিকায় এ যেন স্কুলের মতো ১৫/২০ জনের মতো নিয়মিত ৩টি ব্যাচে ছাত্র ছাত্রী পড়ালেখা করে থাকে। প্রতিটি ব্যাচে ২ ঘণ্টা করে সময় থাকে।

এক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন । ছাত্ররা তা মেনে চলে। যেমন-ছাত্র ছাত্রীর নিয়মিত উপস্থিতি ও সময়জ্ঞান মেনে চলা, পড়া আদায়ে দায়িত্বশীল থাকা, পাঠদানে ছাত্র শিক্ষক ডায়েরী অনুসরণ করে চলা, ডায়েরীর বিষয়াদি সময় তারিখ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা, স্কুলে ও বাড়িতে ছাত্র ছাত্রী নিয়মিত পড়ালেখা করে কিনা নজর দারি রাখা, অভিভাবকদের এসব বিষয়ে সময়ে সময়ে অবহিত করা, ঘন ঘন পরীক্ষা নেয়া, সকল বিষয় পাঠের অন্তর্ভুক্ত রাখা, ছাত্রদের পাঠদানে কোন অবহেলা শৈথল্য প্রশয় না দেয়া ও ছাত্রের চলাফেরা, আচার আচরণ পাঠের অন্তর্ভুক্ত করা। ঝুলন চক্রবর্তী যেমন নিয়মের ভেতর থাকেন, তেমনি তার কোচিং সেন্টারে ছাত্র ছাত্রীদের এসব শৃংখলা মেনে চলতেই হয়। এ জন্য দেখা গেছে অভিভাবক ছাত্ররা তার প্রতি আকৃষ্ট। এখানে ছাত্র ছাত্রী এক বছরের নিচে পড়ে না। এজন্য অনেকে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম পর্যন্ত এক নাগাড়ে পড়েছে এমনও উদাহরণ আছে। ফলাফলের ক্ষেত্রে কেউ ফেল করছে তেমন নজির নেই। ভাল রেজাল্ট নিয়েই উত্তীর্ণ হচ্ছে। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে মুখস্ত পাঠ আদায়ের চেয়ে খাতায় লিখে দিয়ে পড়া আদায় করে থাকেন। ঘন ঘন পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তিনি নোট বই নয় মূল বই থেকে ছাত্র ছাত্রীদের পড়া আদায়ে উৎসাহিত করেন। তবে তিনি জানান, নোট বই এর বিশাল দাপট উপেক্ষা করে চলা কঠিন। সরকার এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেও পুরো মাত্রায় তা বন্ধ হয়ে যায়নি।

তার কোচিং সেন্টারে শিক্ষা নিতে আসা ছাত্র ছাত্রীদের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেলো, এখানে এসে তারা শিক্ষকের নিবিড় সহজ পদক্ষেপ সবকিছু বুঝে নিতে পারে।

শিক্ষক ঝুলন চক্রবর্তী মনে করেন, এটা নিছক কোন কোচিং সেন্টার নয়। তিনি বছরে অন্তত একবার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা সফরে যান এবং তার যাবতীয় খরচ তিনি বহন করেন। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্র ছাত্রীদের কাগজ কলম ইত্যাদি নিজ খরচে সরবরাহ করেন। এজন্য কোন ফি দিতে হয় না। তিনি এ পেশায় থেকে কোন সরকারি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীর মতো নন; এ বোধ তাকে বিক্ষত করে না। তিনি শিক্ষকের মতো দিনরাত এ কাজে পড়ে আছেন। তিনি বিশেষ কোনো পেশায় আছেন কি নেই, এই ভাবনা তাকে পীড়িত করে না। তিনি শুণ্য নন। স্ব-নিয়োজিতভাবে জীবনের ঠিকানা তৈরী করেছেন। তিনি ছাত্রদের মাঝে বেঁচে আছেন তাতেই তার আনন্দ। এটাই তার ব্রত। প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন ব্যাচে ১০০ জনের অধিক ছাত্র ছাত্রীকে নিয়মিত পড়ান। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম অক্ষুন্ন রাখতেও তার সহযোগী শিক্ষকদের প্রচেষ্টাও কোন অংশে কম নয়। প্রচার নয় কাজেই বিশ্বাসী এই নির্মম বাস্তবতাকে বুকে লালন করে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার কারণে তিল তিল করে গড়ে উঠা তার এই প্রতিষ্ঠানটি আজ হয়ে উঠেছে কমলগঞ্জের শিক্ষা বিস্তারে একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে। তাছাড়া মেধাবী দ্ররিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠদান করাচ্ছেন।

সর্বোপরি একটা নির্মল আনন্দ, সম্মান, শ্রদ্ধা ছাত্র অভিভাবকদের মিলে পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ক যা ৩৩ বছর ধরে গড়ে উঠেছে তা টাকা- পয়সার বিবেচনায় দেখা যায় না। এরাও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত রয়েছেন।

এই প্রাপ্তি অনেক মূল্যবান। এখন ছাত্র পড়িয়ে যে আয় রোজগার হচ্ছে তা হেডমাস্টারের থেকে কম নয়। তবে এ রোজগার শতভাগ স্বচ্ছ। এতে তথাকথিত পেশাদারির কোন গোপন কিছু নেই। বয়সের হিসাবে ঝুলন চক্রবর্তী ৪৯ বছরে পা রেখেছেন। পরবর্তী বাকি জীবনও তিনি এভাবেই কাটাতে চান।

তিনি বলেন, এমন সুন্দর মহৎ কাজের মধ্যে বেঁচে থাকার আনন্দ আলাদা। সংসার জীবনে তিনি স্ত্রী, ২ কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রী সরকারি চাকরিজীবী (বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত)।