আব্দুর রাজ্জাক রাজা: জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় চেয়ারম্যান পদে ২৭ জন ,সংরক্ষিত সদস্যপদে ১৯ জন এবং সাধারণ সদস্যপদে ৬৮ জন। মোট ১১৪ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন (২৫ আগস্ট) প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় সংশ্লিষ্ট পদে আর কোনো প্রতিদ্বন্দী না থাকায় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা এসব প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতেন্ত্র সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষিত হয়। ফলে, নাগরিকগণ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতি অনেকটাই আস্বাশীল। তবে, বিভিন্ন দেশে এই গণতন্ত্রের স্বরুপ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও, এই সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য থাকে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
গণতন্ত্র’ শব্দের উৎপত্তি গ্রীক ভাষায় ডেমোক্র্যাটিয়া থেকে। এর অর্থ, ‘জনগণের দ্বারা শাসন। এটি দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দকে একত্রিত করেছে: ‘ডেমো(উবসড়)’ অর্থ একটি নির্দিষ্ট নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী সমগ্র নাগরিক এবং ‘ক্র্যাটোস(কৎধঃড়ং)’ অর্থ ক্ষমতা বা শাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিছু গ্রীক নগর-রাজ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। গণতন্ত্রের জনক বলা হয় এরিষ্টটলকে। তবে, আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হলেন জন লক। গণতন্ত্র হল একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে আইন, নেতৃত্ব, নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি প্রণয়ন করতে জনগণ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গণতন্ত্র হল এমন একটি সমাজ যেখানে নাগরিকরা সার্বভৌম এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। গণতন্ত্র হল একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে নাগরিকরা সরাসরি তাদের ক্ষমতা প্রযোগ করে এবং সরকারী প্রতিনিধিদের নির্বাচন করার অধিকার রাখে। এটি এমন এক ধরনের সরকার যা নাগরিকদের দ্বারা শাসিত হয় এবং জনগণের কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে যা সরকার তাদের থেকে কেড়ে নিতে পারে না এবং এই অধিকারগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং নিশ্চিত। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন এর মতে, ‘‘গণতন্ত্র হল জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকার।’’ ডাইসির (উরপবু) মতে, ‘‘গণতন্ত্র হল সরকারের একটি রূপ যেখানে পরিচালনা পরিষদে সমগ্র জাতির একটি বড় অংশ অন্তর্ভুক্ত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটই প্রধান উপায়। আর ভোট বলতে বোঝায় গোপন ব্যালটে স্বাধীন ও নির্ভয়ে নাগরিকের অধিকার প্রয়োগ। অর্থাৎ একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রতিনিধি বেঁচে নেয়ার সুযোগ হচ্ছে নির্বাচন। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
নির্বাচন মানেই প্রতিদ্ব›িদ্বতা। প্রতিদ্ব›িদ্বতাহীন নির্বাচন মূলত সিলেকশন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো পদে একাধিক প্রার্থী না থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জয়ী ঘোষণা যেহেতু অসাংবিধানিক বা বেআইনি নয়, সুতরাং কেন একে নির্বাচন বলা যাবে না ?
এই যুক্তিতে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত কাউকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি কেন একটি পদের বিপরীতে একাধিক প্রার্থী থাকেন না সেই প্রশ্ন তোলাও সংগত। সা¤প্রতিক বছরগুলোয় কেন এই প্রবণতা বেড়েছে তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের নির্বাচনেও তার ঢেউ লেগেছে। প্রশ্ন হলো, কেন জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার এমনকি বেসরকারি সংগঠনের নির্বাচনেও প্রার্থিরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জয়ী হয়ে যাচ্ছেন ?
স¤প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ২০২১-২৩ সাল মেয়াদি নির্বাচনের সর্বশেষ ধাপে সভাপতি ও সাত সহ-সভাপতি পদে আট পদে আট জনই বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন বোর্ড। গতবারও বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জয়ী হন ৪২ পরিচালক। বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা এখন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক চর্চার পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর আগে উপজেলা নির্বাচনের চার ধাপে ১০৮ চেয়ারম্যানও বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। যখন কেউ বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন, তখন সেখানে নাগরিকের এই সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণœ হয়। সেটি স্থানীয় সরকার হোক কিংবা জাতীয় সংসদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেড় শ’র বেশি প্রার্থী এমপি বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিরল। ভোটে কোনো প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকল না, ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলেন না, তবে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে গেলেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উৎসাহিত করা উচিত নয়। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা যাবে কি না, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে কি না এবং এরকম বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা কেন বাড়ছে সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার। কারণ বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে একসময় পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
নির্বাচনকে আমি কেবল প্রার্থীর বা দলের জয়-পরাজয় বলে মনে করি না। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রে উত্তরণের একমাত্র অবলম্বন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য না হলে ক্ষমতার হস্তান্তর স্বাভাবিক হতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তির নৈরাশ্য বৃদ্ধি পায়।
লেখক: আব্দুর রাজ্জাক রাজা, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।