মুঘল সাম্রাজ্যের বংশধরদের বাস এখন বস্তির ঘুপড়ি ঘরে!

প্রকাশিত: ৫:২৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২০
ছবি সংগৃহীত

ধলাই ডেস্ক: পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল এক সাম্রাজ্য ছিল। যেটি ছিল ভারত উপমহাদেশের একটি সাম্রাজ্য। এটি মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্য মানে পরিচিত। উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়।

মুঘল সম্রাটরা মুসলিম ছিলেন তবে জীবনের শেষের দিকে শুধুমাত্র সম্রাট আকবর ও তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর নতুন ধর্ম দীন-ই-ইলাহির অনুসরণ করতেন। সব জায়গায় তাদের বেশ নামডাক হয়েছিল। সমাজের সবক্ষেত্রেই মুঘলদের অবদান অসামান্য।

সম্রাট শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মাসজিদ, দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়।

শিবাজী ভোসলের অধীনে মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হয়। আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে তিন দশমিক দুই মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। এসময় সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

৪০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুঘলরা

৪০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুঘলরা

মুঘল শব্দটির আবির্ভাব

মুঘল শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে মোঙ্গল শব্দটি থেকে। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর পিতার দিক থেকে চেঙ্গিস খান এবং মাতার দিক থেকে তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। এর মধ্যে চেঙ্গিস খান ছিলেন মোঙ্গল বা তাতার। আর তৈমুর লং ছিলেন তুর্কি। সমসাময়িকরা বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে তিমুরি বা তৈমুরী সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন।

যা মুঘলরা নিজেরাও ব্যবহার করত। ফারসি ভাষায় মোঙ্গল শব্দটি মুঘলে রূপান্তরিত হয়। পাশ্চাত্যে মুঘল বা মোঘুল শব্দটি সম্রাট ও বৃহৎ অর্থে সাম্রাজ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হত। তবে বাবরের পূর্বপুরুষরা সাবেক মঙ্গোলদের চেয়ে ফারসি সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন।

১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যর ৪০০ বছরের শাসনের ইতি ঘটান। ব্রিটিশরা সম্রাটের কয়েকজন পুত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফলে পরিবারের অনেকজন জীবন বাঁচাতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, হায়দ্রাবাদ, উদয়পুরে পালিয়ে যায়।

মুঘল সাম্রাজ্যের সময় অনেক নিদর্শন নির্মিত হয়

মুঘল সাম্রাজ্যের সময় অনেক নিদর্শন নির্মিত হয়

মুঘল বংশধরদের করুণ দশা

পরবর্তীতে অনেকেই নিজেদেরকে মুঘল বংশধর বলে দাবি করে। তবে বর্তমানে কয়েকজন মুঘল বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায়। যারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় করুণ অবস্থায় বেঁচে আছেন। দিন এনে দিন খেয়ে জীবন পার করছেন। সরকারের দেয়া সামান্য ভাতা দিয়ে সংসার চালাতে প্রতি মুহূর্তে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চলুন ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য মুঘোলদের কয়েকজন বংশধরের বর্তমান অবস্থার কথাই জানাবো আজ-

সুলতানা বেগম  

তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ নবাব বাহাদুর শাহ জাফরের নাতবৌ। সুলাতানার স্বামী মির্জা বেদের বুকত ১৯৮০ সালে মারা যান। এরপর থেকেই তার জীবনে দারিদ্রতা নেমে আসে। সুলতানা সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাতা হিসেবে পান মাত্র ছয় হাজার টাকা। যা দিয়ে ছয় ছেলেমেয়েসহ পুরো সংসার চালাতে হয় তাকে। বর্তমানে কলকাতার বস্তি এলাকায় বসবাস করেন তিনি। দুই রুমের একটি ছোট্ট বাসায় পুরো পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি।

বস্তিতে বাস সুলতানা বেগমের

বস্তিতে বাস সুলতানা বেগমের

প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলিতভাবে রান্নাঘর ব্যবহার করেন। পাবলিক পাম্পের পানি ধরা, সেখানে কাপড় ধৌত করেন। সরকারের দেয়া সামান্য ভাতার উপর ভরসা করেই তিনি পাঁচ মেয়ে এবং এক ছেলেকে লালন পালন করছেন। সুলতানা জানান, তাদের আত্মীয়ের অনেকেই যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং অন্য উন্নত দেশগুলোতে বসবাস করেন। যদিও তাদের কারো সঙ্গেই তার যোগাযোগ নেই।

জিয়াউদ্দিন তুসি

জিয়াউদ্দিন তুসি

জিয়াউদ্দিন তুসি

তিনি বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরাধিকার। মুঘল সাম্রাজ্যের এই উত্তরাধিকার বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সরকার মুঘল উত্তরাধিকারীদের পাওনা সম্পদ ফিরিয়ে দিবেন। তিনি সরকারকে প্রত্যক উত্তরাধিকারীদের ভাতা প্রধান করার দাবি জানিয়েছেন যা সরকার পূর্বেই বন্ধ করে দিয়েছিল।

বেগম লায়লা উমাহানি

বেগম লায়লা উমাহানি

বেগম লায়লা উমাহানি

তার পিতা মির্জা পিয়েরে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের নাতি। তিনি এবং তার মা হাবিব বেগম হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলী খান এর আত্মীয়। লায়লা বলেন, স্বামী ইয়াকুব মঈনউদ্দিন তুসিসহ তিনি অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫টি পরিবহন রিকশা ভাড়ার মাধ্যমে তাদের সংসার চলে। তিনি ৩০ বছর পূর্বে ৮০ রুপিতে মাসিক ভাড়া নেয়া বাড়িতে বসবাস করছেন। যা এখনো পরিশোধ করতে হচ্ছে।

যারা ৪০০ বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করে এসেছে। তাদের উত্তরাধিকারীদের আজ নিদারুন দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে বসবাস করতে হবে, তা হয়তো অনেকেরই কল্পনাতীত। তবে এটাই বাস্তবতা। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন তার তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব। সফল এবং দয়ালু একজন শাসক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তবে ১৭১২ সালে তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। ১৭১৯ সাল পর্যন্ত চারজন দুর্বল সম্রাট পরপর শাসন করেছেন।

মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। মধ্য ভারতের অধিকাংশ মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায়। নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং এতে মুঘল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। তবে মুঘল সম্রাটকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হত।

সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান। তবে তাকে বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্তানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি। আর এজন্যই ১৭৬১ সালের সংগঠিত তৃতীয় পানি পথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। ১৭৭১ সালে মারাঠারা আফগান-মুঘলদের কাছ থেকে দিল্লি পুনর্দখল করে নেয়। ১৭৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে উঠে।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতন

মুঘল সাম্রাজ্যের পতন

মুঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণ

এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হয়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয়। ইতিহাসবিদরা মুঘল সাম্রাজের পতনের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেন।

অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যে প্রধান অফিসার, আমিরদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় রাজস্ব ছিল না। আঞ্চলিক শাসকদের উপর সম্রাট নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেনাবাহিনীকে অধিক মাত্রায় আগ্রাসী মারাঠাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনব্যপী চলমান যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে।

ফররুখসিয়ারের মৃত্যুর পর স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করে। ১৯৭০ এর দশক থেকে ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকভাবে পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দেখা যায়, উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে অসাধুতা, অত্যধিক বিলাসিতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের বাহ্যিক হুমকির ব্যাপারে অপ্রস্তুত করে তোলে।

একটি মার্ক্সবাদী মতানুযায়ী, ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারণে শাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যায়। আরেকটি মতানুযায়ী, হিন্দু ধনী সম্প্রদায় মুঘল সাম্রাজ্যের বদলে মারাঠা ও ব্রিটিশদের অর্থসহায়তা প্রদান করে। ধর্মীয় দিক থেকে বিচারে বলা হয়, হিন্দু রাজপুতরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তবে চূড়ান্ত মত হিসেবে অন্যান্য পণ্ডিতরা বলেন, সাম্রাজ্যের অত্যাধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে অধিক মাত্রায় স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ যোগায় এবং রাজ দরবারকে দুর্বল করে তোলে।

শুধু যে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারদের এই অবস্থা তা কিন্তু নয়! শের শাহ অর্থাৎ টিপু সুলতান এবং বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার উত্তরাধিকারদেরও এমন করুন অবস্থার কথা জেনেছি। ভাবতেই কেমন অবাক লাগে, যারা একসময় দাঁপিয়ে বেড়িয়েছে সারা ভারতবর্ষ, শাসন করেছে শত শত বছর তাদেরই বংশধররা আজ সরকারের দেয়া ভাতার মুখাপেক্ষী। সেই শাসকরা কি কখনো তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিদারুন জীবনের কথা ভেবেছিলেন? হয়তো না, ভাবলে নিশ্চয় রাজ্য হারানোর ভুলগুলো করতেন না।

সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…