খালিদ সাইফুল্লাহ্: ১. কবি নির্মলেন্দু গুণের মতে, “আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি”। পৃথিবী থাকার জায়গা নয়। সময় ফুরালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। এমনটাই নিয়ম। কিন্তু যাঁরা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের আনন্দ-বেদনাকে বা’পাশে রেখে পরিবার ও সমাজের মানুষের মন-মননে মহৎ কীর্তির নির্মল ছবি এঁকে যেতে পারেন, শত চড়াই উৎরাই পেরিয়েও জীবনের রথযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরাই তো প্রকৃতপক্ষে সৌভাগ্যবান সফল মানুষ। আর তাঁদেরই একজন আমার পিতা মোঃ বজলুর রহমান। ১৭ ই মে ২০২০ সাল, ২৩ রমজান দুপুর ২ ঘটিকার সময় আমার পিতা মাত্র ৬৫ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে । এমন আকস্মিক বিদায়ের জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সারাজীবন নির্লোভ, অসীম সাহসী, নিঃস্বার্থ পরোপকারী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমার সম্মানিত পিতা প্রচলিত ক্ষমতার বাইরে থেকেও মানুষের উপকারে আজীবন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটি বিনয়, মোলায়েম ও মোহাবিষ্ট কথার জাদু দিয়ে মানুষকে অতিদ্রুতই আপন করে নিতে পারতেন। অসুবিধায় পতিত কাউকে দেখলে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন, সর্বশক্তি দিয়ে হলেও বিপদ-আপদে, অসুখ-বিসুখে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। ছোট বড় সবাইকেই সর্বাগ্রে সালাম দিয়ে পরিবার পরিজনের খোঁজ-খবর নিতেন। মৃত্যু, কুলখানি, বিয়ে ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠানাদি দাঁড়িয়ে থেকে সম্পন্ন করে দিতেন। তিনি কাউকে কখনও খালি হাতে ফেরত দিতেন না। নিভৃতে দান করতেন। অনেক সময় সাধ্য থেকেও বেশি কিছু করতে চেষ্টা করতেন। নিজে অপারগ হলে ব্যবস্থা করে দিতেন। ভোজন-রসিক এই মানুষটি খেতে ও খাওয়াতেও ভীষণ ভালোবাসতেন। উনার সবচে’ বড় চারিত্রিক গুণ, উনার সম্মুখে কেউ কখনও অন্যায়-অবিচার করে পার পেতো না। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতেন। হক কথা বলতে কখনও বিন্দুমাত্র পরোয়া করতেন না, উনার অপ্রিয় সত্য কথাগুলো কাউকে অসন্তুষ্ট করলেও চোখে চোখ রেখে সৎ সাহস নিয়ে অকপটে বলে ফেলতেন। কত অমীমাংসিত বিচার, কত ঘোরতর ঝগড়া, কলহ কখনও চোখ রাঙিয়ে বা ধমক দিয়ে বা সস্নেহে বুঝিয়ে মিটমাট করে দিতেন। উনার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই বিভিন্নসময় বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা নিতেন। সরলতার সুযোগে অনেকেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে ঢালস্বরূপ ব্যবহারও করে নিতেন। বিশেষত নির্বাচনের সময় এলে উনার কাছে অনেকেই ভিড় জমাতেন। উনার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কৌশল কাজে লাগালোর জন্য তাদের পাশে টানতে চেষ্টা করতেন। যদিও পরবর্তীতে অতিথি পাখিগুলোর অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। তবুও জীবনের শেষ অবধি তিনি কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়া তাদের সবার নিঃস্বার্থভাবে শুধু উপকার করে গেছেন।
২. সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনদের ভুলে গেলেও তিনি তাঁদের খুঁজে খুঁজে বের করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, জোরগলায় পরিচয় দিতেন, তাঁদের সুখে-দুখে খোঁজ-খবর নিতেন, এমনকি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও সবসময় সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। জীবনের শেষ অবধি এভাবেই সবার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন। উনার সংস্পর্শে এসে কত মানুষ ভালোর পথে ফিরে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। তিনি নামাজের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন। উনার দাওয়ার বদৌলতে অনেক বেনামাজি নামাজ পড়া শুরু করেছে, অনেক বিপদগামী, অবসাদগ্রস্ত, মনোবলহারা কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পেয়েছে। নামাজের প্রতি পরম ভালোবাসার জন্যই বোধহয় উনাকে স্বপ্নে নামাজের পরিবেশে কেউ কেউ দেখে থাকেন। এছাড়াও তিনি শিরক-বিদআত, কুসংস্কারের ব্যাপার বরবরই কঠোর থাকতেন। উনার সম্পর্কে অবাক করা কথা হল, হবিগঞ্জে সর্ববৃহৎ মহাল ব্যবসায় পার্টনারের ভুলের কারণে উনার প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বিক্রির টাকা লোকসান হলেও হিন্দু পার্টনারের কষ্ট হবে ভেবে তাকে সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্তি দিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। অথচ অন্যরা ওই হিন্দু ভদ্রলোক থেকে ঠিকই জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করে।
৩. তিনি একসময় প্রভাবশালী সর্বকনিষ্ঠ মহালদার, প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার ও ধর্নাঢ্য পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকার হয়েও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাননি, কাউকে টকানি, প্রতারণা করেননি, অবৈধ উপার্জন করেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন পরিধেয় পরিস্কার পোশাকের মতোই স্বচ্ছ, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও স্পষ্টবাদিতার উপর অবিচল। আর তাই কখনও কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা জনপ্রতিনিধি না হয়েও বিগত সময় ৪টি মিথ্যা মামলা (রাষ্ট্র কর্তৃক দায়েরকৃত ৩ টি রাজনৈতিক মামলায় প্রধান অভিযুক্ত) মোকাবিলা করতে হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত একটি মামলায় দীর্ঘসময় চেষ্টা করে সুপ্রীম কোর্ট থেকে একাধিকবার জামিন নিতে হয়। দীর্ঘ জীবনের শেষ ১৫-২০ বছর বিভিন্ন সময় কখনও সুপ্রীম কোর্ট বা জজকোর্টে, কখনও আইনজীবীদের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে পার করতে হয়। মাসের পর মাস আত্মগোপনে থাকতে হয় এবং এসবের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়। আল্লাহর মেহেরবাণীতে সৌভাগ্যবশত একদিনও কারান্তরীণ না হয়ে মৃত্যুর বছরখানেক পূর্বে পর্যায়ক্রমে ৪ টি মামলায় বেকসুর খালাস লাভ করার পর হয়তো ভেবেছিলেন এবার কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল একদম ভিন্ন। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে চিরদিনের জন্য বিশ্রাম দিয়ে দিলেন।
৪. দু’টি মেয়ে সন্তানের জন্মের পর মা-বাবার কোল আলো করে পৃথিবীতে এলে ধনবান পিতা পুত্রের মুখখানা দেখে এতোটাই আনন্দিত হন যে, সমগ্র এলাকার ঘরে ঘরে এতো মিষ্টি বিলি করেন , সেদিন কোনো মিষ্টির দোকানে অবশিষ্ট মিষ্টি খোঁজ করে পাওয়া যায় নি। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য জীবনের প্রথমার্ধে এতোটাই রাজকীয় জীবন-যাপন করতেন যে, লাহোর-করাচী থেকে স্যুট-কোর্ট এনে পরতেন, হরেক পদের খাবার মেহমান নিয়ে খেতেন, ঢাকার সবচে’ দামী ব্রান্ডের সানগ্লাস চোখে দিতেন, নিউ মডেলের দামী মোটরবাইক ব্যবহার করতেন , পাজারো জিপ ব্যবহার করতেন, ৭০ দশকের শুরুর দিকে ৫০০ শত টাকার নোট ভাঙ্গিয়ে সবচে’ দামি ব্রান্ডের সিগারেট খেতেন। তবে দক্ষিণ সিলেটের এক ধর্ণাঢ্য-অভিজাত পরিবারের ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যের মাঝে সোনার কাঠি মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া এই মানুষটিকে মৃত্যু অবধি জীবনের পদেপদে অতিমাত্রায় সরলতা, উদারতা ও অগাধ বিশ্বাসের চড়া মূল্য চুকাতে হয়। তাই জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত দৃঢ় মনোবল আর পাথরের মতো অবিচল থেকেও হৃদয়ে জমাটবাঁধা দীর্ঘদিনের প্রচণ্ড কষ্ট-অভিমান নিয়ে আকস্মিকভাবে হার্ট অ্যাটাক করে পাড়ি জমাতে হয় মহান রবের দরবারে। সবাই দু’আ করবেন, আল্লাহ্ যেনো উনাকে জান্নাত দান করেন, আমীন।
৫. আল্লাহ বলেন- “আমাকে ভয় করো, আমার আনুগত্য করো, আমার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখো, আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো এবং সম্মানিত করবো।” তিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আল্লাহর উপর প্রচণ্ড বিশ্বাস রাখতেন, ভয় করতেন, আনুগত্য করতেন এবং বলতেন আল্লাহ্ উত্তম ফয়সালাকারী। তাই আল্লাহ্ উনার বান্দাকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ও পরবর্তী সময় সম্মানিত করেন। জীবিত অবস্থায় তিনি সর্বাবস্থায় যেমন ছিলেন উঁচু শিরের অধিকারী, দারাজ কন্ঠ, সুদৃঢ় মনোবল, শুভ্র কপাল, নুরানি-হাস্যোজ্বল চেহারার অধিকারী, আল্লাহর মেহেরবানীতে মৃত্যুর পূর্ব অবধি তিনি নিজের আভিজাত্য, স্মার্টনেস ও অবস্থান একইরকম ধরে রেখেছিলেন । এমনকি মৃত্যুর সময়ও উনার চেহারাতে যন্ত্রণার ভাঁজ, অসহায়ত্ব বা মলিনতার ছাপ ফুটে ওঠেনি, চোখে বেয়ে অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে নি, বরং মৃত্যুর পর উনার চেহারা থেকে দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে, কপালে শুভ্রতা ভেসে ওঠে । করোনার প্রকট মহামারিতে প্রশাসনের কঠোর বাধাবিপত্তির মাঝে উনার জানাজার নামাজ খুব সীমিত পরিসরে হলেও এটিকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে থেকে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। উনার তিরোধান জীবনের শুরুর মতো হয়তো এতো জৌলুসপূর্ণ, চাকচিক্যময় ছিল না, কিন্তু অন্তিম যাত্রা ছিল অনেক সম্মানজনক, প্রশান্তিময় এবং অনাড়ম্বরপূর্ণ রাজকীয়। আমাদের প্রায়সময় বলতেন, আমার মতো এতো ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যের মাঝে তোমাদের বড় করতে পারিনি। তবে কখনও কেউ যেনো তোমাদের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে তাই নিজেকে সবসময় স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করেছি। তোমাদের দীনি ও দুনিয়াবি দু’ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত করে যাচ্ছি ও অন্তর থেকে দু’আ করে যাচ্ছি।
৬. একজন মানুষকে সবাই ভালোবাসতে বা শ্রদ্ধা করতে পারে না এবং তা সমীচীনও নয়। কারণ মানুষ নিজেকে ভালো-মন্দের বাটখারায় মেপেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে স্ব স্ব ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে। তাই আমি বলবো না, আমার পিতাকে সবাই ভালোবাসতেন বা শ্রদ্ধা করতেন বা এখনও ভালোবাসেন বা শ্রদ্ধা করেন। তবে দার্শনিক সুইফটের মতে, তোমার মৃত্যুর পর যদি কেউ না কাঁদে, তোমার জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমি দেখেছি আমার পিতার জন্য অনেক মুসলিম অমুসলিম, আত্মীয় অনাত্মীয়কে অশ্রু বিসর্জন দিতে। তাই তিনি আমার কাছে একজন খাঁটি হৃদয়ের সফল মানুষ এবং যে জীবন আমার কাছে আজীবন শুধুই প্রেরণার। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম বা কবি মির্জা গালিব বা রেঙ্গুইনে নির্বাসিত শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মতো বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। তাঁদের মতো লিখতেও জানতেন না। তাই তাঁদের মতো হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো হয়তো সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে যেতে পারেননি। জীবনের রস ও নিরস অভিজ্ঞতাগুলো জানিয়ে যেতে পারেননি কলমের খোঁচায় খোঁচায়। কিন্তু জায়নামাজে বসে সিজদায় অবনত হয়ে মহান রবের দরবারে অশ্রুভেজা নয়নে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলতেন হৃদয়ের প্রতিটি ফরিয়াদ, ভাঙ্গা-গড়া জীবনের অব্যক্ত ডায়েরী, সময়ের সাথে মিশে চলা প্রতিটি বেদনার্ত অনুভূতি। ইতিহাস হয়তো খলিফা আবদুল হামিদের মতো শত বছর পর উনার জীবনের অব্যক্ত গল্প ড্রামা আকারে তুলে ধরবে না । ইতিহাস হয়তো সিকি পরিমাণও উনাকে স্থান দিবেন না কোনকালেই। মহাকাল হয়তো চিরতরে মুছে দিবেন একটি বেদনাভেজা অধ্যায়। তবুও তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমার হৃদয়ের সিংহাসনে হয়ে চির অমলিন।
লিখেছেনঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ এলএল.বি. (অনার্স), এলএল.এম. কবি ও শিক্ষানবিশ আইনজীবি, সিলেট জজকোর্ট, ৮ মে ২০২১