যেমন ছিলেন আমার বাবা

প্রকাশিত: ৪:১৯ অপরাহ্ণ, মে ১১, ২০২১
ছবি ধলাইর ডাক
খালিদ সাইফুল্লাহ্:  ১. কবি নির্মলেন্দু গুণের মতে, “আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি”। পৃথিবী থাকার জায়গা নয়। সময় ফুরালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। এমনটাই নিয়ম। কিন্তু যাঁরা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের আনন্দ-বেদনাকে বা’পাশে রেখে পরিবার ও সমাজের মানুষের মন-মননে মহৎ কীর্তির নির্মল ছবি এঁকে যেতে পারেন, শত চড়াই উৎরাই পেরিয়েও জীবনের রথযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরাই তো প্রকৃতপক্ষে সৌভাগ্যবান সফল মানুষ। আর তাঁদেরই একজন আমার পিতা মোঃ বজলুর রহমান। ১৭ ই মে ২০২০ সাল, ২৩ রমজান দুপুর ২ ঘটিকার সময় আমার পিতা মাত্র ৬৫ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে । এমন আকস্মিক বিদায়ের জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সারাজীবন নির্লোভ, অসীম সাহসী, নিঃস্বার্থ পরোপকারী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমার সম্মানিত পিতা প্রচলিত ক্ষমতার বাইরে থেকেও মানুষের উপকারে আজীবন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটি বিনয়, মোলায়েম ও মোহাবিষ্ট কথার জাদু দিয়ে মানুষকে অতিদ্রুতই আপন করে নিতে পারতেন। অসুবিধায় পতিত কাউকে দেখলে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন, সর্বশক্তি দিয়ে হলেও বিপদ-আপদে, অসুখ-বিসুখে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। ছোট বড় সবাইকেই সর্বাগ্রে সালাম দিয়ে পরিবার পরিজনের খোঁজ-খবর নিতেন। মৃত্যু, কুলখানি, বিয়ে ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠানাদি দাঁড়িয়ে থেকে সম্পন্ন করে দিতেন। তিনি কাউকে কখনও খালি হাতে ফেরত দিতেন না। নিভৃতে দান করতেন। অনেক সময় সাধ্য থেকেও বেশি কিছু করতে চেষ্টা করতেন। নিজে অপারগ হলে ব্যবস্থা করে দিতেন। ভোজন-রসিক এই মানুষটি খেতে ও খাওয়াতেও ভীষণ ভালোবাসতেন। উনার সবচে’ বড় চারিত্রিক গুণ, উনার সম্মুখে কেউ কখনও অন্যায়-অবিচার করে পার পেতো না। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতেন। হক কথা বলতে কখনও বিন্দুমাত্র পরোয়া করতেন না, উনার অপ্রিয় সত্য কথাগুলো কাউকে অসন্তুষ্ট করলেও চোখে চোখ রেখে সৎ সাহস নিয়ে অকপটে বলে ফেলতেন। কত অমীমাংসিত বিচার, কত ঘোরতর ঝগড়া, কলহ কখনও চোখ রাঙিয়ে বা ধমক দিয়ে বা সস্নেহে বুঝিয়ে মিটমাট করে দিতেন। উনার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই বিভিন্নসময় বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা নিতেন। সরলতার সুযোগে অনেকেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে ঢালস্বরূপ ব্যবহারও করে নিতেন। বিশেষত নির্বাচনের সময় এলে উনার কাছে অনেকেই ভিড় জমাতেন। উনার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কৌশল কাজে লাগালোর জন্য তাদের পাশে টানতে চেষ্টা করতেন। যদিও পরবর্তীতে অতিথি পাখিগুলোর অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। তবুও জীবনের শেষ অবধি তিনি কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়া তাদের সবার নিঃস্বার্থভাবে শুধু উপকার করে গেছেন।
২. সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনদের ভুলে গেলেও তিনি তাঁদের খুঁজে খুঁজে বের করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, জোরগলায় পরিচয় দিতেন, তাঁদের সুখে-দুখে খোঁজ-খবর নিতেন, এমনকি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও সবসময় সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। জীবনের শেষ অবধি এভাবেই সবার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন। উনার সংস্পর্শে এসে কত মানুষ ভালোর পথে ফিরে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। তিনি নামাজের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন। উনার দাওয়ার বদৌলতে অনেক বেনামাজি নামাজ পড়া শুরু করেছে, অনেক বিপদগামী, অবসাদগ্রস্ত, মনোবলহারা কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পেয়েছে। নামাজের প্রতি পরম ভালোবাসার জন্যই বোধহয় উনাকে স্বপ্নে নামাজের পরিবেশে কেউ কেউ দেখে থাকেন। এছাড়াও তিনি শিরক-বিদআত, কুসংস্কারের ব্যাপার বরবরই কঠোর থাকতেন। উনার সম্পর্কে অবাক করা কথা হল, হবিগঞ্জে সর্ববৃহৎ মহাল ব্যবসায় পার্টনারের ভুলের কারণে উনার প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বিক্রির টাকা লোকসান হলেও হিন্দু পার্টনারের কষ্ট হবে ভেবে তাকে সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্তি দিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। অথচ অন্যরা ওই হিন্দু ভদ্রলোক থেকে ঠিকই জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করে।
৩. তিনি একসময় প্রভাবশালী সর্বকনিষ্ঠ মহালদার, প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার ও ধর্নাঢ্য পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকার হয়েও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাননি, কাউকে টকানি, প্রতারণা করেননি, অবৈধ উপার্জন করেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন পরিধেয় পরিস্কার পোশাকের মতোই স্বচ্ছ, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও স্পষ্টবাদিতার উপর অবিচল। আর তাই কখনও কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা জনপ্রতিনিধি না হয়েও বিগত সময় ৪টি মিথ্যা মামলা (রাষ্ট্র কর্তৃক দায়েরকৃত ৩ টি রাজনৈতিক মামলায় প্রধান অভিযুক্ত) মোকাবিলা করতে হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত একটি মামলায় দীর্ঘসময় চেষ্টা করে সুপ্রীম কোর্ট থেকে একাধিকবার জামিন নিতে হয়। দীর্ঘ জীবনের শেষ ১৫-২০ বছর বিভিন্ন সময় কখনও সুপ্রীম কোর্ট বা জজকোর্টে, কখনও আইনজীবীদের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে পার করতে হয়। মাসের পর মাস আত্মগোপনে থাকতে হয় এবং এসবের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়। আল্লাহর মেহেরবাণীতে সৌভাগ্যবশত একদিনও কারান্তরীণ না হয়ে মৃত্যুর বছরখানেক পূর্বে পর্যায়ক্রমে ৪ টি মামলায় বেকসুর খালাস লাভ করার পর হয়তো ভেবেছিলেন এবার কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল একদম ভিন্ন। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে চিরদিনের জন্য বিশ্রাম দিয়ে দিলেন।