কমলগঞ্জের ভানুগাছ-শমশেরনগরের মধ্যবর্তী রেলপথে ১০ হাজারের অধিক ক্লিপ-হুক গায়েব

প্রকাশিত: ৬:৪২ অপরাহ্ণ, জুলাই ৭, ২০১৯

কমলগঞ্জ সংবাদদাতা: বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেল লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রেলপথ থেকে অব্যাহতভাবে চুরি হচ্ছে ক্লিপ-হুক। রেল লাইনের সাথে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক চুরির ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে রেল লাইন। বরমচাল এলাকায় উপবন ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলের গাফলতি ও ক্লিপ-হুক চুরির ঘটনা নজরে এসেছে। সেকশনের ভানুগাছ থেকে শমশেরনগর পর্যন্ত রেলপথে ১০ হাজারেরও অধিক ক্লিপ, হুক গায়েব হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেকশনের রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের উপর জীনশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সাথে পেরেক দিয়ে বাঁশের ফালি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ট্রেন চলাচলের সময় যেকোনো মুহুর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। উপবন এক্সপ্রেস বরমচালের বড়ছড়া ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। তবে সেকশনের ভানুগাছ থেকে শমশেরনগর পর্যন্ত রেলপথে ১০ হাজারেরও অধিক ক্লিপ, হুক গায়েব হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ আমলের তৈরি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেলপথ ও কালভার্ট ব্রিজ সমুহ সংস্কারের অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সরেজমিনে রেলপথের শমশেরনগর ও ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের এলাকার কয়েকটি স্থান ঘুরে এচিত্র পাওয়া গেছে।

বিশেষ করে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের রেললাইন ঘুরে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এ দৃশ্য চোখে পড়ে। যেন লাউয়াছড়া বনের ভেতরের রেলপথ সাজানো রয়েছে মৃত্যুর ফাঁদ। দেশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও সিলেট রেলপথের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক। তার চেয়েও নাজুক লাউয়াছড়া বনের রেলপথটি।

১৯৯৭ সালে ১৪ই জুন কমলগঞ্জের মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে শত বছরের পুরনো সিলেট রেলপথটির লাউয়াছড়া বনের রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল কয়েক মাস। পরে ক্ষতিগ্রস্ত লাইনটি সংস্কার করার পর বনের ভেতরের অংশ আর সংস্কার কিংবা মেরামত না করায় বনের ভেতরের ৮ কি.মি. রেলপথের পুরো লাইন জুড়েই বর্তমানে শুধু নেই নেই অবস্থা। জয়েন্টে নাট-বল্টু নেই, স্লিপার ভাঙা, স্লিপারের হুক নাই, রেললাইনের স্লিপারে পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে স্লিপারের মধ্যখানে বালু দিয়ে রাখায় রেললাইনের নড়বড়ে অবস্থা। এ অবস্থায় নড়বড়ে এ রুটেই ঘটে দেশের সব চেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা।

রেলপথে স্লিপারসমূহে নাট-বল্টু দিয়ে রেল লাইন আটকানো থাকার কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ক্লিপ, নাট-বল্টু নেই। রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। ভানুগাছ, শমশেরনগর, টিলাগাঁও স্টেশনের মাঝখানে অসংখ্য স্থানে ক্লিপ-হুক নেই। বিশেষ করে ভানুগাছ স্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের মাত্র পাঁচশ’ মিটার এর মধ্যে রেলপাতের সাথে ৪১২টিতেই ক্লিপ পাওয়া যায়নি। গোপালনগর ও ফাজিলপুর এলকার ৩০২/৭ নম্বর পিলার পর্যন্ত দু’ধারে প্রায় ৪১৬টি ক্লিপ নেই। এমনকি দু’টি লাইনের সংযুক্ত স্থানেও ক্লিপ গায়েব হয়ে গেছে। এলাকার রেলপথে স্লিপার সমূহে নাট-বল্টু দিয়ে রেল লাইন আটকানো থাকার কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ক্লিপ, নাট-বল্টু নেই। রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হওয়ায় অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়ছে। দিনের পর দিন ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু, ফিশপ্লেট চুরি হওয়ায় সেকশনটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ট্রেন চলাচলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। চুরি যাওয়া ওসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না।

এদিকে গত ৭ মে রাতে সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের শমশেরনগর রেল স্টেশনের অদূরে দক্ষিণ পাশে ৩০৬/২ নম্বর রেলপথ বাঁক এলাকায় রেলপথের পাতে ফাটল দিয়ে বারো ইঞ্চি ফাঁক তৈরি হয়। এতে ট্রেনের বড় ধরণের দুর্ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এ সময়ে এক স্কুল শিক্ষার্থীর সচেতনতায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা থেকে যাত্রীবাহী আন্ত:নগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি রক্ষা পায়। রেল সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেলপথের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে রয়েছে ৮ কি.মি. রেলপথ। এই পথের মধ্যে ছোট-বড় ৬টি ব্রিজ রয়েছে।

আলাপকালে শমশেরনগরের ব্যবসায়ী আকমল হোসেন, প্রণয় পাল, নুরুল মোহাইমীন, সমাজকর্মী সিদ্দিকুর রহমান, ভানুগাছ বাজারের ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, রেলপথ থেকে অসংখ্য স্লিপার ও হুক চুরি হওয়ায় ট্রেনে যেতে এখন ভয় করে। অতীতে ট্রলিযোগে প্রকৌশলী বিভাগের লোকজন নিয়মিত রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য রেলপথে ঘুরে বেড়াতেন। তাছাড়া শ্রমিকদেরও রেলপথ, কালভার্ট, ব্রিজে কাজ করতে দেখা যেতো। প্রতিনিয়ত সংস্কার কার্যক্রম পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে এচিত্র চোখে পড়ে না। এখন রেল সেকশনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্ণীতি গ্রাস করছে। তারা আরও বলেন, স্টেশন সমুহে টিকিট বিক্রিসহ নানা বাণিজ্য নিয়ে মাস্টারসহ অন্যান্যরা ব্যস্ত থাকেন। ফলে ট্রেন, রেলপথ ও কালভার্ট-ব্রিজে কোন সমস্যা আছে কি না সেটি তাদের কাছে মুখ্য নয়। মানুষের জীবনের চেয়ে টাকা কামানোটাই মুখ্য।

সরজমিনে লাউয়াছড়া বনের ভেতর ঘুরে দেখা যায় মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি থেকে চোংগার পুল পর্যন্ত রেললাইনের অবস্থা খুবই নাজুক। পাহাড়ি এলাকার এই অংশের মধ্যে রেললাইনের একটি স্থানে রেলপাত অংশ গলে ক্ষয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। জয়েন্টের প্লেটের ৪টি নাট-বল্টুর মধ্যে কোথায় ২-৩টি রয়েছে। কোনো কোনো জয়েন্টে নাট থাকলে বল্টু নেই। আবার কোথাও নাট ক্ষয়ে যাওয়ায় কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জয়েন্টে নাট-বল্টু না থাকায় রেলপাতগুলো উঁচুনিচু হয়ে বেশ কম অবস্থায় রয়েছে। এক স্থানে ১২টি স্লিপারের মধ্যখানে কোনো পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে দিয়ে রাখা হয়েছে বালু। অধিকাংশ স্লিপার ভাঙা। স্লিপার ধরে রাখার হুক খুলে পড়ে আছে। লাউয়াছড়া বনের পাহাড়ি রেলপথ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে যাত্রীরা দেখলে হয়তো এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন না।

সিলেট-আখাউড়া সেকশনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে ৬টি আন্তঃনগরসহ বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন। রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দু’বার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫-৩০ হাজার যাত্রী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা জানান, কিছু কিছু অংশে সমস্যা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই বলে ওই রেলওয়ে কর্মকর্তা জানালেও গত তিন বছরে সিলেট রেলপথে অন্তত ২০-২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৩শে জুন রাতে কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া সেতুতে। ওইদিন সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেন সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।

সাধারণ যাত্রীরা বলেন, ‘আমরা রেলপথকে সব চেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা মনে করি। কিন্তু সিলেট রেলপথটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কি বলব। এ রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রহস্যজনক কারণে এই পথটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেল বিভাগের স্থানীয় কৌশলীদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা যায়নি। রেলের স্থানীয় পর্যায়ের কেউও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের প্রকৌশলী বিভাগের কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে কুলাউড়াস্থ রেলওয়ের গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী মনিরুল ইসলাম বলেন, ভানুগাছ স্টেশনের আউটারে একটি বেইলী ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তবে কাজ চলছে কিছুদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তাছাড়া হুক, ক্লিপ না থাকলে সেখানে কাজ করা হচ্ছে। ব্রিজ কালভার্ট সমুহে জনগণের সুবিধার্থে মাঝে মধ্যে বাঁশের টুকরো আটকানো হয়। তবে রেলপথ এখন স্বাভাবিক ও সমস্যাযুক্ত স্থানে কাজ চলছে বলে তিনি দাবি করেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকার প্রধান দপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান জাবির বলেন, ১ হাজার কাঠের স্লিপার আনা হয়েছে। সিলেট বিভাগের যেসব স্থানে স্লিপার একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে সেগুলো স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের সবকটি রেলসেতু নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।