কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া উদ্যানের র্দূগম পাহাড়ি পথে ট্রেন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে

প্রকাশিত: ১০:০৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ৮, ২০১৯

কমলগঞ্জ সংবাদদাতা: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উঁচু পাহাড়ি টিলার এলাকার আখাউড়া-সিলেট রেলপথে রেললাইনের রেলপাত ক্ষয় হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে,রেল লাইনের পাতের জয়েন্টে ৪টি নাটের জায়গায় আছে ২-৩টি, নাট-বল্টু না থাকায় জয়েন্ট গুলো নেই ঠিকমত, স্লিপার ভাঙ্গা, স্লিপারের হুক খুলে পড়ছে, স্লিপারের মধ্যখানে পাথরের পরিবর্তে বালু, কোথাও পাথর বিহীন রেল লাইনটি শুণ্যে রয়েছে। এছাড়া প্রায়ই উঁচু টিলা অতিক্রম করতে না পেরে ট্রেন আটকা পড়ে পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড়ি এলাকায় ট্রেন আটকা পড়লে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন। বৃষ্টির দিনে ও ঘন কুয়াশার সময়ে মালবাহী ট্রেন ও মেইল ট্রেন ইঞ্জিনে বালুর বস্তা নিয়ে যেতে হয়।

সরেজমিনে সিলেট- আখাউড়া রেলপথের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যাণের ভেতরের রেল লাইন ঘুরে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এ দৃশ্য চোখে পড়ে। যেন লাউয়াছড়া বনের ভেতরের রেলপথ সাজানো রয়েছে মৃত্যুর ফাঁদ।

১৯৯৭ সালে ১৪ জুন কমলগঞ্জের মাগুড়ছড়া গ্যাসকুপ বিস্ফোরনে শতবছরের পুরনো সিলেট রেল পথটির লাউয়াছড়া বনের রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে বনের ভেতরের ৮ কিঃমিঃ রেল পথের লাইন সংস্কার করে চালু করা হয়। পুরো লাইন জুড়েই বর্তমানে শুধু নাই নাই অবস্থা। জয়েন্টে নাট-বল্টু নাই,স্লিপার ভাঙ্গা,স্লিপারের হুক নাই,রেল লাইনের স্লিপারে পাথর নাই,পাথরের পরিবর্তে স্লিপারের মধ্যখানে বালু দিয়ে রাখায় রেল লাইনের নড়েবড়ে অবস্থ্া।

জানা গেছে, শুধু লাউয়াছড়া বন নয় পুরো সিলেট রেল পথ জুড়েই রেললাইনে ক্লিপ, নাট, হুক, ফিসপ্লেট, স্লিপার, গার্ডার বয়সের ভারে নুজ্য। একে অপরের পরিপুরক পুরাতন ওই খুচরা নানা ছোট-বড় যন্ত্রাংশ এখন অধিকাংশই অকেজো। আর যেগুলো আছে রয়েছে, সেগুলোও সংখ্যায় অপ্রতুল। রেল পথে নির্মাণকৃত ব্রিজগুলো নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ব্রিজে কোনো মেরামত কাজ হয়নি। এর ফলে অনেকটা ব্রিজের উপরের রেললাইন রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

রেল সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেল পথের কমলগঞ্জরে ভানুগাছ ও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে রয়েছে ৮ কিঃমিঃ রেলপথ। এই পথের মধ্যে ছোট-বড় ৬টি ব্রিজ রয়েছে। সরেজমিন লাউয়াছড়া বনের ভেতর ঘুরে দেখা যায় মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি থেকে চোংগার পুল পর্যন্ত রেল লাইনের অবস্থা খুবই নাজুক। জয়েন্টের প্লেটের ৪টি নাট-বল্টুর মধ্যে কোথায় ২-৩টি রয়েছে। কোনো কোনো জয়েন্টে নাট থাকলে বল্টু নেই। জয়েন্টে নাট-বল্টু না থাকায় রেলপাত গুলো উচঁনিচুঁ হয়ে বেশকম অবস্থায় রয়েছে। এক স্থানে ১২টি স্লিপারের মধ্যখানে কোন পাথর নেই,পাথরের পরিবর্তে দিয়ে রাখা হয়েছে বালু। অধিকাংশ স্লিপার ভাঙ্গা। স্লিপার ধরে রাখার হুক খুলে পড়ে আছে। অনেক স্থানে কাঠের উপর থেকে লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোথাও স্লিপার ভেঙ্গে পাথর বিহীন রেল লাইন শূণ্যে রয়েছে।

শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত প্রতিটি স্থান মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ন এই রেল লাইনের উপর ভর করে হাজারো জীবন নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে সিলেট থেকে ঢাকা ও চট্রগ্রাম পথে উভয়দিকে ১০টি যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেন, ৪টি মেইল ট্রেন, ২টি সাধারন ট্রেন মিলিয়ে মোট ১৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। তাছাড়া তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও সারবাহী ট্রেন চলাচল করে।

রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দুইবার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫/৩০ হাজার যাত্রী। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে রাজি না।

শমশেরনগর স্টেশন মাস্টার কবির আহমদ ও শ্রীমঙ্গল স্টেশন মাস্টার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আসলে ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশন থেকে এ ২টি পাহাড়ি টিলা প্রায় ১শ ফুট উপরে। শীতকালে আর বৃষ্টির দিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের এ ২টি টিলা অতিক্রম করতে না পেরে প্রায়ই ট্রেন আটকা পড়ে। তথ্য অনুয়ায়ী গত বছর ২৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার ভোর রাত ৪ টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী ৭৩৯ নং ডাউন আন্তঃনগর উপবন ট্রেন লাউয়াছড়া উদ্যানের পাহাড়ি এলাকার টিলা অতিক্রম করতে না পেরে প্রায় ৩০ মিনিট আটকা থাকার পর আবারও শ্রীমঙ্গল স্টেশনে ফিরে যায়। পরে ভোর ৫টায় ট্রেনটি চালালে আবারও ট্রেনটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে জাতীয় উদ্যানের মাগুরছড়া এলাকার একটি ভাঙ্গা সেতুর উপর আটকা পড়েছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারী মালামাল বহনকারী ট্রেন অতিক্রমের সময় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২৮ জানুয়ারী সার বহনকারী ট্রেন স্থান অতিক্রম করতে না পেরে পাহাড়ে আটকা পড়েছিল। পরে উদ্ধারকারী আরও একটি ট্রেন ইঞ্জিন এনে সার বহনকারী ট্রেনটিকে টেনে শ্রীমঙ্গল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তার সাথে রেল লাইন নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, কিছু কিছু অংশে সমস্যা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই বলে ওই রেলওয়ে কর্মকর্তা জানালেও গত তিন বছরে সিলেট রেল পথে অন্তত ২০/২৫টি দূর্ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দূর্ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৩ জুন রাতে কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া সেতুতে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেল বিভাগের স্থানীয় কৌশলীদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা যায়নি। রেলের স্থানীয় পর্যায়ের কেউও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।