কমলগঞ্জ প্রতিনিধি: মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির আয়োজনে মনিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মূখার্জ্জীর ১৩৬ তম জন্মবার্ষিকী পালনে কমলগঞ্জ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির আয়োজনে নৃত্যগুরুর জন্মস্থান বালিগাও গ্রামে মন্ডপে (২৬ এপ্রিল) শুক্রবার সকাল ১১ টায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন (অতি; দায়িত্ব) উপ-পরিচালক মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি সভাপতিত্বে ও গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ এর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রাপ্ত লেখক গবেষক রণজিৎ সিংহ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- লেখক গবেষক আহমদ সিরাজ, মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ, মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি সিলেট জেলা শাখার সভাপতি নির্মল সিংহ, মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক নির্মল এস পলাশ, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ পরিচালক দেবানন্দ সিংহ প্রমুখ।
আলোচনা সভা শেষে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিল্পী ও মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির শিল্পীবৃন্দের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশেন করা হয়।
নৃত্যাচার্য নীলেশ্বর মূখার্জ্জী ছিলেন কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মণিপুরী নৃত্য প্রসার ও প্রচারের সহযোগী। মণিপুরি সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে আলাদা ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মণিপুরিদের নৃত্যকলাকে ধর্মীয় আচারের গÐি থেকে বের করে এনে বিশ্বমÐলে স্থান করে দিয়েছিলেন। তার একমাত্র সহযাত্রা ছিলেন নীলেশ্বর মূখার্জ্জী। আর এভাবে নৃত্যগুরুর সঙ্গে কবিগুরু, শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের এক গভীর সখ্য ও আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। গুরু নীলেশ্বর মূখার্জ্জী ও রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায় রাখাল বালকদের যে দলটি রবীন্দ্রনাথের সামনে মণিপুরি গোষ্ঠলীলা পরিবেশন করে, তার একজন ছিলেন নীলেশ্বর মুখার্জি । রবীন্দ্রনাথ নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে ১০ টাকা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের উপজেলার বালিগাঁও গ্রামে। এই নীলেশ্বর মূখার্জ্জীই শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৩৫ সালে। তখন দ্বিতীয় পর্যায়ে মণিপুরি নৃত্যের পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়। খোলা হয় আলাদা বিভাগ। নীলেশ্বর মুখার্জি মৃদঙ্গ শেখানোর দায়িত্ব পান । রবীন্দ্রনাথ তখন উত্তরায়ণের দোতলায় বসে ছিলেন। অনেক দর্শনার্থীর ভিড়। হঠাৎ কবিগুরু বললেন, ‘আজ নীলেশ্বর মূখার্জ্জীর আসার কথা, তাই না?’ ভিড়ের মধ্য থেকে নীলেশ্বর মুখার্জির কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যাঁ, গুরুদেব আমি এসেছি।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কাছে ডেকে মণিপুরি ভাষার গান শুনতে চান তাঁর কাছে। নীলেশ্বর গাইলেন মণিপুরি পালার গান, ‘সাজলো কুসুম শেজ বিছাওল/ বাড়ই বাড়লো রাতির সে মাতি/ আমার বিনোদিনী বিনোদ করে/ সাজলো কুসুম বিছাওল।’ রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘গানটি কত মাত্রার।’ নীলেশ্বর বললেন, ‘বারো মাত্রার।’ মাথা নেড়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘না, আমার মনে হয় চৌদ্দ মাত্রার।’ রবীন্দ্রনাথ জানতেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতিতে শ্রীমতী রাধার এই গান বাঙালি সুরে ১৪ মাত্রায় গাওয়া হয়। কিন্তু বিনয় ও সাহসিকতার সঙ্গে বিশাল সুধী সমাবেশে গানের মাত্রা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন নীলেশ্বর মূখার্জ্জী। তিনি বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি আমাকে কেবল একটি মণিপুরি খোলের ব্যবস্থা করে দিন। আমি খোলের তালে মাত্রা গুনে প্রমাণ করে দেব যে গানটি ১২ মাত্রার।’ তারপর খোল এনে হাজির করা হয়। নীলেশ্বর মূখার্জ্জী উৎসুক দর্শনার্থীদের সামনে খোলের তালে তালে তাঁর আঙুলি দিয়ে মাত্রা সংকেত করে সেদিন প্রমাণ করেছিলেন গানটি ১২ মাত্রার। নীলেশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করে ফেলেন। তাঁর শান্ত স্বভাব ও গুণী শিল্পীর গুণ দেখে মুগ্ধ হন। নীলেশ্বরের অনুরোধে কবি ‘কোন দেবতা সে কী পরিহাসে’ গানটি চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে সংযোজন করেন। ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘কুঞ্জ দ্বারে নব মল্লিকা’ এই দুটি রবীন্দ্রসংগীত মণিপুরি নৃত্যের তালে তালে সার্থক ভাবে মঞ্চে নিয়ে আসেন নীলেশ্বর। ১৯৩৬ সালে পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লাহোর ও মিরাটে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। সেই সব মঞ্চায়নে নীলেশ্বর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীলেশ্বরের নৃত্য দক্ষতায় ১৯৩৮ সালে শিলংয়ে এবং ১৯৪০ সালে আসানসোল, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে পুনর্মঞ্চায়িত ‘শাপমোচন’, ‘রথের রশি’ ইত্যাদি নাটকেও তিনি ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে মণিপুরি নৃত্যকলার যে সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছিল, তার সঙ্গে নীলেশ্বর মুখার্জি এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন।