কমলগঞ্জ প্রতিনিধি: মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষায় চা বাগান মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মজুরিসহ বাগান বন্ধের সিদ্ধান্ত না নেয়ার প্রতিবাদে ১১ এপ্রিল শনিবার দেশের সব চা বাগানে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ১০ মিনিটের প্রতিবাদ কর্মসুচী-মানবন্ধন করার ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভার পর এই সিদ্ধান্ত নেন। মানবন্ধনে বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। শনিবার সকালে কাজে যাওয়ার আগে ফাঁড়ি বাগানসহ প্রতিটি চা বাগানে “মানববন্ধন ” (মানব অবস্থান) অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি বাগানে চা শ্রমিকদের পক্ষে ১০ জন প্রতিনিধি ১০ মিনিটের জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচি পালনে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে অফিস-আদালত সবই এখন বন্ধ। তবে ছুটি নেই চা-বাগানের কর্মীদের। তাই ১১ এপ্রিল শনিবার সকালে ‘১০ মিনিটের প্রতিবাদ’ কর্মসূচি দিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। সংগঠনের কেন্দ্র্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রামভজন কৈরী শুক্রবার বিকেলে এ কথা জানিয়েছেন।
১০ এপ্রিল শুক্রবার এ কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। কিন্তু পবিত্র শবে বরাতের কারণে তারিখ পিছিয়ে ১১ এপ্রিল শনিবার নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৬৬টি চা-বাগান রয়েছে। এসব বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও চা-শিল্প এর আওতার বাইরে পড়ে যায়। অথচ বাগানের শ্রমিকেরা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করেন। ফলে তাঁদের ঝুঁকি বেশি। এ অবস্থায় বাগানে ছুটি ঘোষণার যৌক্তিকতা তুলে ধরে চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদসহ (বিটিএ) বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। এর প্রতিবাদ জানাতে শনিবার সকালে কাজে যোগদানের আগে সব বাগানে অন্তত ১০ জন শ্রমিক ব্যানার নিয়ে একটি নির্ধারিত স্থানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবেন।
কমলগঞ্জ উপজেলার মৃর্তিঙ্গা চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির নেতা ধনা বাউরি বলেন, অন্য সবার মতো আমরাও দেশের নাগরিক। এমনিতেই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা আমরা ঠিকমত পাইনা। সেখানে করোনার মতো রোগ আসলে আমাদের কী হবে তা কল্পনাও করা যায় না। তাই আমাদের নিরাপদ জীবনের স্বার্থে সরকার ঘোষিত ছুটি কার্যকর করা হোক।
চা শ্রমিকরা জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভারতের আসাম রাজ্যের ৮৬০টি চা বাগানের কাজ বন্ধ ঘোষণার খবর এলে তারাও এই দাবি তোলেন। নিজ ব্যবস্থায় এবং কিছু কিছু বাগান হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে তবে তা এত অপ্রতুল যে অধিকাংশ শ্রমিকও সে সুযোগ পাচ্ছেন না। আমরা কাজ করি এক সঙ্গে। বিকেলে যখন পাতা জমা দেই তখন সবাই কাছাকাছি লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দেই। এতে একজনের সংক্রমণ হলে সবার হতে পারে। ছুটি দেয়া হলে বেতন-ভাতা পরিশোধের বাধ্যবাধকতার অজুহাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বাগান মালিকরা। তাই আমাদের মজুরিসহ ছুটি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
কমলগঞ্জ উপজেলার কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক নেতা, শমশেরনগর ইউপি সদস্য ও মাসিক চা মজদুর সম্পাদক সীতারাম বীন বলেন, ইতিমধ্যে কমলগঞ্জের সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ইউনিয়নের চাম্পারায় চা বাগানসহ কয়েকটি বাগানে ঢাকা ফেরত একাধিক ব্যক্তি ঢুকে পড়ছে। তাই আমরা খুবই আতংকের মাঝে আছি। চা বাগানে নির্ধারিত শ্রমিকের সাথে সাথে ওই পরিবারে আরো বেশ কিছু শ্রমিক রয়েছে, যাদের বাগানে কাজ নেই তারা, ইট ভাঙাসহ বিভিন্ন ধরণের দিনমজুরের কাজ করেন। “এখন সব কিছু বন্ধ থাকায় তারা বেকার হয়ে ঘরবন্দি। তাদের জন্য সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।”
তবে বাংলাদেশ চা-সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বলেন, চা-বাগানে এখন পর্যন্ত কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। করোনার সংক্রমণ রোধে আগে থেকেই বাগানগুলোতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলা হয়েছে। তাঁদের মাস্ক-সাবান দেওয়া হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করতে বলা হয়েছে। আর চায়ের ব্যবসা এমনিতেই খারাপ। ছুটি দিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রভাব শ্রমিকদের ওপরও পড়বে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে চা-বাগানে ছুটি ঘোষণার কোনো নির্দেশনা নেই। এ ব্যাপারে সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা দরকার।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে চা বাগানের শ্রমিকেরা দল বেঁধে কাজে যাচ্ছেন। বাগানগুলোতে করোনা সংক্রমিত হলে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। চা শ্রমিকরা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করেন। নিত্যপ্রয়োজনে হাটবাজার ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে চলাচল করেন। আমরা সরকার এবং মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি কিন্তু কেউই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় ছুটির দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। সবাই বলছে সরকার নির্দেশ দিলে ছুটি ঘোষণা করা হবে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি আহ্বান করতে হয়েছে। ইতিমধ্যে মোবাইল ফোনে সব ভ্যালির (কয়েকটি চা-বাগান নিয়ে একটি ভ্যালি গঠিত) সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে কর্মসূচির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী কাছেও চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তারা আবেদন পাঠাবেন বলে জানান তিনি।