ধলাই ডেস্ক: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সামনে ঝুলছে নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি। সিনিয়র নেতাদের ফাঁসি, রাজনৈতিক মামলার কারণে কোণঠাসা দলটি। দীর্ঘদিন ধরে নেই সভা-সমাবেশ ও কোনো কর্মসূচি। ৬০ বছরে পা রাখা দলটি আমির নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।
সাড়ে ৯ বছরের বেশি সময় জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে দায়িত্বে থাকা মকবুল আহমদ শারীরিকভাবে অসুস্থতার কারণে নির্বাহী পরিষদে অবসর নিতে চিঠি দেন। যা ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। যে কারণে ডিসেম্বরেই দেখা যাবে নতুন আমিরকে। মূলত জামায়াতের রোকনদের মাধ্যমেই নির্বাচিত হবেন পরবর্তী আমির।
জামায়াতের প্রচার বিভাগ থেকে জানা গেছে, মকবুল আহমদ ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি তিনি।
জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী আমির নির্বাচিত হবেন। সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় আড়াইশ শুরা সদস্য রয়েছেন। এসব শুরা সদস্যদের ভোটে তিনটি প্যানেল করা হয়েছে। এ তিন প্যানেলের তিনজন প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে যে কাউকে ভোট দেবেন রোকনরা। যদিও প্যানেলের বাইরে অন্য কোনো সিনিয়র নেতাকে ভোট দেয়ার সুযোগ আছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত তিন প্যানেলে রয়েছেন- জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, দলটির বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ও আরেক নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, খুব শিগগিরই সারাদেশের রোকনদের কাছে পৌঁছে যাবে নির্বাচনের ব্যালট। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের রোকনরা ভোট দেবেন। ভোটগ্রহণ শেষে নভেম্বরের শেষেই জানা যাবে পরবর্তী কে হচ্ছেন জামায়াতের আমির।
কেন্দ্রীয় জামায়াতের একাধিক সূত্রে জানা যায়, আমির নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন’ হিসেবে কাজ করছেন চার সদস্যের একটি টিম। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবু তাহের মাছুম নির্বাচন কমিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কমিশনের বাকি সদস্যরা হলেন- জোনাল ইনচার্জ আবদুর রব, অফিস সহকারী আবদুস সাত্তার ও বায়তুল মাল সম্পাদক শাহাবুদ্দীন।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্যানেলের তিন প্রার্থীর মধ্যে রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক অবস্থান, সিনিয়রিটি ও সংগঠনের প্রতি দায়বদ্ধতায় যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই হবেন জামায়াতের আমির।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের জন্ম রাজশাহীতে। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৮৬ সালে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এক সময় জামায়াতে ইসলামীর রাজশাহী মহানগরীর সাবেক আমির, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান জামায়াতের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র নায়েবে আমির।
তাছাড়া জামায়াতের সাবেক দুই আমির মতিউর রহমান নিজামী ও অধ্যাপক গোলাম আজমের কাছাকাছি ছিলেন দীর্ঘদিন। এ ছাড়া ঢাকার রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিতে রয়েছে সক্রিয় ভূমিকাও।
ডা. শফিকুর রহমান
ডা. শফিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি সিলেটের কুলাউড়ার ভাটারায়। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা জাসদ ছাত্রলীগের হাত ধরে। ১৯৭৪ সালে সিলেটের এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর সেখান থেকে পাস করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস-এ ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রশিবিরে যোগ দেন। সেখানেও শিবির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জামায়াতে আসার পর ডা. শফিকুর রহমান সিলেট মহানগরীর আমির, অবিভক্ত জেলা আমির এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের একটি মেডিকেল কলেজ ও শিশু হাসপাতালের মালিকদের একজন।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
মিয়া গোলাম পরওয়ার ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার শিরোমণি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে বিএল কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে বিকম ও এমকম পাস করার পর অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
১৯৭৫ সালে ছাত্র থাকাবস্থায় জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে ছাত্রশিবিরের খুলনা মহানগরীর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খুলনা মহানগরে জামায়াতের আমির এবং ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) আসন থেকে জামায়াতের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে একই আসনে ১৯৯১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হন।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় এক কর্মপরিষদ সদস্য জানান, জামায়াতে আমির নির্বাচনে জ্যেষ্ঠতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতেও সিনিয়রিটি হিসেবেই আমির নির্বাচন হয়েছে। বর্তমানে দলের চারজন নায়েবে আমির রয়েছেন। তারা হলেন- অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (সাজাপ্রাপ্ত), মিয়া গোলাম পরওয়ার, আ ন ম শামসুল ইসলাম। এখান থেকে যেহেতু দুজন নায়েবে আমির প্যানেলে আছেন আমার মনে হয়, তাদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত হবেন।
জামায়াতের মজলিসে শুরার এক সদস্য বলেন, দলের সিনিয়রিটি এবং যোগ্যতা অনুযায়ী আমির নির্বাচনে প্রাধান্য পায়। যে যোগ্য তিনিই আমির হবেন। অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সাবেক এমপি ও সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমান হতে পারেন পরবর্তী আমির।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অন্যতম পর্যবেক্ষক ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘জামায়াত একটি সংঘবদ্ধ দল ও গণতান্ত্রিক দল। এখানে নেতা নির্বাচনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, পদেরও কোনো লোভ নেই। চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী দল চলে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের নেতা বা আমির নির্বাচিত হয়। এবারের আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্যানেলের তিন সদস্যই যোগ্য।
নতুন আমিরের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, যেই আমির নির্বাচিত হোক না কেন, মাঠের রাজনীতিতে যেহেতু জামায়াত সক্রিয় নেই সুতরাং চ্যালেঞ্জও কম। তবে জামায়াতের অন্য যেসব কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো এগিয়ে নেয়াই হবে নতুন আমিরের চ্যালেঞ্জ।
প্রসঙ্গত, মকবুল আহমদ জামায়াতের তৃতীয় নির্বাচিত আমির। এর আগে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী দলটির নির্বাচিত আমির ছিলেন। এর বাইরে বিভিন্ন সময় প্রয়াত আব্বাস আলী খান, মাওলানা আবদুর রহিম দলটির ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্বে পালন করেন।
সূত্র: জাগো নিউজ…