ধর্ম ডেস্ক: হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, রমজান মাস তোমাদের মাঝে উপস্থিত। এ মাসে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাস হতে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে সবকিছু হতেই বঞ্চিত হলো। শুধু হতভাগারাই এ সম্মানিত রাত হতে বঞ্চিত হয়। এ রাতের ফজিলত বর্ণনায় বোখারি শরিফের এক হাদিসে রাসুল (সা.) আরো বলেন, যে ঈমানের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে লাইলাতুল কদরের রাতে ইবাদত করবে, আল্লাহ তার জীবনের পেছনের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।
শবে কদরের সংজ্ঞা
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর অর্থ মর্যাদাপূর্ণ রাত। কোনো কোনো আরবি অভিধানে কদর অর্থ ‘ভাগ্য’ ধরে এ রাতকে ভাগ্য নির্ধারণ রাতও বলা হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে সমগ্র কোরআনুল কারিম লাওহে মাহফুজ হতে দুনিয়ার প্রথম আসমানে একসঙ্গে নাজিল করেছেন বিধায় এ রাতের মর্যাদা অন্য যেকোনো হাজার মাসের চেয়েও বেশি দান করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হচ্ছে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) রবের অনুমতিক্রমে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। এ সম্পর্কে সুরা কদরে বলা হয়েছে শান্তিময় এ রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত। হজরত আয়শা (রা.) এ রাতে কোন দোয়া পড়বেন- রাসুলের (সা.) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ এই দোয়া পড়বে।
যে কারণে শবে কদর করা হলো
তাফসিরে মাজহারি ও মারেফুল কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা.) এক দিন সাহাবিদের সামনে বনি ইসরাইলের এক আবেদ ও জাহিদ ব্যক্তির আমল-আখলাকের বর্ণনায় বলছিলেন, ওই ব্যক্তি দীর্ঘ এক হাজার মাস রাতে ইবাদত এবং দিনে সিয়াম পালন ও জিহাদের মাধ্যমে সওয়াব লাভ করতেন। এটা শুনে সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের অল্প আয়ুর কথা স্মরণ করে খুব আফসোস করছিলেন। এ সময় আল্লাহ পাক সুরা কদর নাজিল করে ঘোষণা দিলেন, লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত যা হাজার মাস অপেক্ষা অধিক মর্যাদাবান। তাই শবে কদরের রাতে ইবাদত করলে অন্য সময়ের এক হাজার মাস তথা ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদতে কাটানোর সমান সওয়াব হয়।
কেন এত মর্যাদাপূর্ণ
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির হেদায়াতের জন্য একশ চারখানা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ হলো কোরআনুল কারিম, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী মুহাম্মদের (সা.) ওপর নাজিল করেছেন। আর এ মহাগ্রন্থ লাইলাতুল কদরেই নাজিল করা হয়। তাই কোরআনুল কারিমের সম্মানেই এ রজনীর এত বড় মরতবা। কোরআনের বিভিন্ন সুরায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি কোরআনকে মোবারকময় রজনি ও রমজান মাসে অবতীর্ণ করেছি।’
শবে কদর কোন দিন
নির্দিষ্ট করে শবে কদর চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কারণ রাসুল (সা.) নিজেই বলেছেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে। অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা তালাশ কর। মূলত কদরের রাত নির্দিষ্ট থাকলে সবাই এ রাতের অপেক্ষায় থাকত, যা শরিয়তসম্মত নয়। তবে অধিকাংশ মুজতাহিদের মতে ২৬ রমজানের দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৭ রমজানের রাতই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর তদনুযায়ী আমরা রাত যাপন করে থাকি।
সহজে কদর পাওয়ার উপায়
নিশ্চিতভাবে লাইলাতুল কদরের রাত লাভ করা সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত রাত। রাসুল (সা.) রমজানের প্রথম দশ দিন ও মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করে বললেন, জিব্রাইল (আ.) এসে বলে গেলেন, লাইলাতুল কদর শেষের দশ দিনে। যে আমার সঙ্গে ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষের দশ দিনে ইতিকাফ করে। এ হাদিস দ্বারা আমরা নিশ্চিত বুঝতে পারি- লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ দিনে।
কদর রাত চেনার আলামত
কদরের রাত চেনার কিছু আলামতের কথা বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে ও শেষের সাত দিনে তালাশ কর। রাসুল (সা.) আমাদেরকে ২৭ রমজান কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল লাইল করতে বলেছেন।
যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে সেটি বুঝার কিছু আলামত হাদিসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হলো :
১. এ রাতটি রমজান মাসে। আর এ রাতের ফজিলত কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
২. এ রাতটি রমজানের শেষ দশকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর।” (বুখারী)
৩. আর এটি রমজানের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ কর।” (বুখারী)
৪. এ রাত রমজানের শেষ সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রমজানের শেষ সাত রাতের মধ্য তা অন্বেষণ করে।”
৫. রমজানের ২৭ শে রজনি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। ক. হাদিসে আছে : উবাই ইবনে কাব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমজানের ২৭ তম রাত। (মুসলিম) (খ) আব্দুল্লাহ বিন উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমজানের ২৭শে রজনীতে অনুসন্ধান করে। (আহমাদ)
৬. কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল ২৫ তারিখ, তৃতীয় হল ২৯ তারিখে। চতুর্থ হল ২১ তারিখ। পঞ্চম হল ২৩ তারিখের রজনি। [৭] সর্বশেষ আরেকটি মত হল- মহিমান্বিত এ রজনি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধু ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হিকমত ও তার ইচ্ছায় কোনো বছর তা ২৫ তারিখে, কোন বছর ২৩ তারিখে, কোন বছর ২১ তারিখে, আবার কোন বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে।
৭. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
৮. নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
৯. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
১০. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
১১. কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
১২. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
১৩. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত। (সহিহ ইবনু খুযাইমাহ : ২১৯০ ; বুখারী : ২০২১ ; মুসলিম : ৭৬২)
এ রাতে করণীয় আমল
মহিমান্বিত এ রজনীর সব নেয়ামত হাসিলের জন্য প্রথমেই শিরকমুক্ত ঈমান পরিশুদ্ধ নিয়ত ও বিদায়াতমুক্ত আমলের মাধ্যমে রাত যাপন করতে হবে। কদর লাভের আশায় শেষ দশ দিনে ইতিকাফ করা। বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। কোরআন তেলাওয়াত করা। দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ও তাওবা-ইসতিগফার করা।
এ রাতে বর্জনীয় কাজ
মর্যাদাপূর্ণ এ রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে মনগড়া কিছু আমলের প্রচলন দেখা যায়, যা শরিয়তসম্মত নয়। অবশ্যই তা বর্জন করতে হবে। লাইলাতুল কদরের নামে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ পড়া, দলবদ্ধভাবে মসজিদে মসজিদে ঘুরে ইবাদত করা, কবর জিয়ারত করা, আতশবাজি করা ইত্যাদি। এ রাত যাপন উপলক্ষে অহেতুক কোনো অনুষ্ঠান বা মসজিদে কোনো ভোজের আয়োজন করা ইসলামসম্মত নয়। বরং বেশি বেশি নফল ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত ও তাওবা-ইসতিগফারের মধ্যে রাত কাটানোই শ্রেয়।
শবে কদর এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য
শবে কদর এ উম্মতের জন্য আল্লাহ পাকের মহান দান। এটাকে কেবল এ উম্মতেরই বৈশিষ্ট্য। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা শবে কদর আমার উম্মতকেই দান করেছেন; পূর্ববর্তী উম্মতকে নয়।
ইমাম মালিক (রহ.) সূত্রে বর্ণিত আছে, যখন রাসুল (সা.)-কে আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ দেওয়া হলো যে আপনার উম্মতের বয়স অন্যান্য উম্মতের তুলনায় কম হবে, তখন তিনি আল্লাহর সমীপে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ! তাহলে তো পূর্ববর্তী উম্মত দীর্ঘ জীবন পেয়ে ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে যে স্তরে উপনীত হয়েছে, আমার উম্মত সে স্তর লাভ করতে পারবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.)-কে লাইলাতুল কদর দান করেন এবং এটাকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা দেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদর রাতের সব ফজিলত লাভের সুযোগ দান করুন। আমিন
সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ…