এক অন্নের পরিবার এখন একান্নে পরিনত হচ্ছে

প্রকাশিত: ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২

আব্দুর রাজ্জাক রাজা: “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” সিলেট অঞ্চলের আব্দুল করিমের গাওয়া গানটির কথা মনে করিয়ে দেয় অতিতেত ফেলে আসা দিনগুলো কতই না মধুর ছিল। একটা সময় দেশের প্রতিটি পরিবার ছিল একই বৃন্তে অনেক ফুলের মতো। সকলেই সকলকে নিয়ে ভেবেছে, যেন কেউ ঝরে না পড়ে। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও গ্রামের একই উঠান দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ানো গেছে। পঞ্চশের দশকে রান্না হয়েছে একই হাঁড়িতে। সেতো রান্নার হাঁড়ি নয়, যেন কোন উৎসবরে রান্নার আয়োজন। কে আপন ভাইবোন, কে চাচাত ভাই,কে ফুপাত ভাই বা বোন, তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। বড় গৃহস্থ পরিবার হয়ে একেবারে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার পর্যন্ত একই দৃশ্য দেখা যেত। এমনকি সম্পর্কে গ্রামের ভাই চাচারাও ছিল পরিবারের একান্ত স্বজনের মতো। বলা হতো একই অন্নে লালিত পরিবার বা একান্নবর্তী পরিবার। দিনে দিনে সেই চিত্র এখন অতীত হয়ে গেছে। যদিও বা এখনো কোথাও কোথাও ছোট পরিসরে একান্নবর্তী পরিবার বিদ্যমান আছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবারের সদস্য বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে পরিবার ভেঙে বসতি গড়ে তোলে নিজেদেরই জমিতে। তারপর পরিবার খন্ডিত হওয়ার সঙ্গে জমি ও খন্ডিত হতে থাকে। বাড়িঘর উঠতে থাকে আবাদী জমির ওপরই।

দাদা, দাদি, মা-বাবা, চাচা, চাচি, ফুফু বা ভাই-বোনদের নিয়ে একসঙ্গে বসবাসের দিন ফুরিয়ে গেছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার। একক পরিবার-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে সমাজে। ফলে পারিবারিকভাবে আলাদা হয়ে যাচ্ছে মা-বাবা, ছেলে-বৌ। নিঃসঙ্গভাবে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম। পরিণত বয়সে এসেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কাটাচ্ছে নিঃসঙ্গ জীবন। তারা বঞ্চিত হচ্ছে যৌথ পরিবারের মেলবন্ধনের আনন্দ আর আদর-স্নেহ-ভালবাসা থেকে। আর এ কারণে অনেক শিশু শৈশব থেকেই হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। একটা সময় ছিল-যখন শহর কি গ্রামের প্রতিটি বাঙালী পরিবারই ছিল একান্নবর্তী। দাদা-দাদী, বাবা-মা, চাচা-চাচী-ফুফু এবং ভাই-বোনের ছিল একসঙ্গে যৌথ বসবাস। বয়োজ্যেষ্ঠ একজন থাকতেন পরিবার প্রধান হিসেবে। তিনিই পরিচালনা করতেন সংসার। আর বাকিরা নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে, প্রয়োজনের তাগিদে যৌথ পরিবারে বসবাসের সংস্কৃতি উঠে গেছে। শহর-কি গ্রামÑসকল স্থানেই এখন গড়ে উঠছে একক পরিবারের বসতি। একান্নবর্তী পরিবারের দেখা এখন খুব কমই মেলে। আজকের নতুন প্রজন্ম হয়ত চিন্তাই করতে পারবে নাÑ কেমন ছিল আমাদের অতীতের পারিবারিক সংস্কৃতি।

নদীর তীর ভাঙ্গার মতোই একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। এটি সময়ের অনিবার্য পরিণতি হলেও এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিশাল আকারে জমি খন্ড-বিখন্ডের পাশাপাশি এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা থেকে শুরু করে লাঠালাঠি-মারামারি ও সামাজিক বিচার-সালিশ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। প্রবীণদের বুক ভাঙ্গা দুঃখ আর গভীর হা-হুতাশের মাঝে চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়ছে বিশাল আকারের ঘর সমুহ। ভাগ হচ্ছে উঠান। জমিজমা। কাটা পড়ছে গাছপালা। ভাগ হয়ে যাচ্ছে পুকুর। গরু-মহিষ থেকে শুরু করে হাঁস-মোরগ পর্যন্ত। চার-পাঁচ দশক পূর্বে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একান্নবর্তী পরিবারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে এমন দু’ চারজনের দেখা মিলেছে, যারা একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে অন্য রকমের গৌরব বোধ করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তা ইতিহাসে রূপ নিয়েছে। উপরন্তু একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ভূমি ব্যবস্থায় রীতিমতো ধস নেমেছে।
যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া সম্পর্কে কয়েকজন প্রবীণ গভীর দুঃখ নিয়ে বলেন, সেসব দিন সত্যিকার অর্থেই ভাল ছিল। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেকার সৌহার্দ,বিপদ-আপদে একে-অপরের সহায়ক ভুমিকা বা অংশগ্রহন ছিল। সেই সময়গুলোতে সুখে-দুঃখে একে-অপরের মধুর হাসি মাখা সেসব দিন হারিয়ে যাওয়ায় সত্যিই কষ্ট কর, তীব্র বেদনাদায়ক।

“ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ”Ñ জানি না কবে কে কখন কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে এই বাণীটি লিখেছিলেন। তবে যখন যে উদ্দেশ্যেই এই বাণীটি লিখেছিলেন, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ বা উদ্দেশ্য ছিল। রক্তের বাঁধন ভাই। রক্তের বাঁধন ছিন্নের জন্য শুধুই নারীই দায়ী, তা আমি বলবো না। তবে সময়ের প্রয়োজনে নারীকে অনেক কিছুরই শিকার হতে হয়। এছাড়া ছোটখাট দ্বন্দে জড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে চলা একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙার আরও তথ্য মিলেছে। সংসারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রবণতা, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ বিশেষ করে নারীদের নানা আবদার পূরণ করতেই ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার।

প্রবীণরা বলছেন, বিশেষ করে আধুনিক যুগের মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে এসেই সংসারে কর্তৃত্ব চায়। পূর্বে শাশুড়ি বা ননদ, জায়েদের সাথে সমান ধরনের শ্রম ঘাম দিয়ে সংসার গুছিয়েছে রাখতেন। পরিবারে সকল কাজ ভাগাভাগি করে করতেন এবং পরিবারের সব কিছুর দিকে খেয়াল রাখতেন। আসলে দিন যতই যাচ্ছে মানুষ নিজেকে এবং নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য টাকার পিছনে ছুটছে। সময়ের সঙ্গে সংসারে খরচও বেড়েছে। এটি ঠিক রাখার জন্য অনেক পরিবারের ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয়ে উঠছে না। একান্নবর্তী পরিবারে সবাই সমান মানসিকতা নিয়ে না চললে সমস্যায় পড়ে যায়। আর এই ভাঙ্গা -গড়ার খেলায় কষ্টে পড়ে যায় পরিবারের এক সময়কার প্রধান বৃত্তিরা অর্থাৎ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।

লেখক: আব্দুর রাজ্জাক রাজা, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।