ডিসেম্বরে রাজপথ উতপ্ত হওয়ার শংকায় নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা

প্রকাশিত: ৯:৪৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৭, ২০২২

আব্দুর রাজ্জাক রাজা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে রাজপথ। রাজনৈতিক দল সমুহ পাল্টাপাল্টি কর্মসুচী হাতে নিয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠন সমুহের কর্মসুচীকে কেন্দ্র করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অজানা আতংক বিরাজ করছে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য নাভিসাশ্ব চলছে। আবার যদি রাজনৈতিক উতপ্তের কারনে কি হয় সেই শংকায় নাগরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা।

আগামী ডিসেম্বরকে টার্গেট করে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে রাজনীতি। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিজয়ের মাসে শোনা যাবে জনতার সমুদ্রগর্জন। দলটির জাতীয় সম্মেলনসহ নানা ইস্যুতে মাসজুড়ে থাকবে কর্মসূচি। এগুলোর মধ্য দিয়ে বড় শোডাউনের পরিকল্পনাও হচ্ছে। আবার বিএনপি নেতারা বলছেন, সব বাঁধা উপেক্ষা করে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ হবে। অচল করে দেওয়া হবে রাজধানী। দুদলের এমন ঘোষণায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আগাম তথ্য দিয়েছেন গোয়েন্দারা। এতে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা শঙ্কা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। আগাম ব্যবস্থা নিতে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
জানা যায়, বিভাগীয় সমাবেশের মধ্য দিয়ে বড় শোডাউন দিচ্ছে বিএনপি। তবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে এখনই সরাসরি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে যাচ্ছেনা আওয়ামী লীগ। আপাতত নিজেদের দলীয় কর্মসূচির মধ্য দিয়েই রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। ডিসেম্বরে দলটির জাতীয় সম্মেলন। এর আগে অক্টোবর ও নভেম্বর জুড়ে তৃণমূল পর্যন্ত দল ও সহযোগী সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজে ব্যস্ত থাকবে। পাশাপাশি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে দলটি। এসব কর্মসূচিতে বড় জনসমাগম বা শোডাউনের পরিকল্পনাও রয়েছে ক্ষমতাসীনদের।
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, বিএনপি যেসব কর্মসূচি পালন করছে, তা তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচি নয়। ফলে এখনই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা ঠিক হবে না। তবে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনে গেলে বা ‘সহিংস কর্মকান্ড শুরু করলে তখন মাঠে পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া হবে। তবে এর আগ পর্যন্ত সারা দেশের নেতাকর্মীদের উস্কানিতে পা না দিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে দলটি।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, বিএনপি কখনোই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাদের লক্ষ্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা। এখন তারা ১০ ডিসেম্বর নিয়ে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা তাদের ফাঁদে পা দিতে চাই না। সামনে আমাদের জাতীয় সম্মেলন। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমরা এর আগে তৃণমূল পর্যন্ত দল গোছানোর কাজ করছি। আমরা আমাদের কর্মসূচি নিয়েই মাঠে থাকব। তবে জনগণকে নিয়ে কেউ খেলতে চাইলে, তাদের ফাঁদে ফেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইলে সহ্য করব না ? জনস্বার্থেই তাদের রুখতে হবে। আরো জানান,২৯ অক্টোবর ঢাকা জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সম্মেলনেও বড় জনসমাবেশের প্রস্তুুতি নেয়া হচ্ছে।
দলীয় সূত্রটি আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক। সে কারণেই জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটিকে মাঠের কর্মসূচিতে ‘কঠোর ভাবে বাঁধা দেওয়া হবে না। তবে একেবারে মাঠ ছেড়েও দেবে না। কারণ, এতে জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা যেতে পারে। তাছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরাও ‘ভয়হীন ও চাঙা হবে’। ফলে কিছুটা চাপে রেখেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে। যাতে বিএনপি বড় সমাবেশ করে তাদের বিব্রত করতে না পারে। পাশাপাশি নিজেদের দলীয় কর্মসূচিতেই বড় জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে নিজেদেরও জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে চায় আওয়ামী লীগ। আরো জানা যায়, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বেশকিছু দিবস পালন করবে। এগুলো হলো, ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস, ১০ নভেম্বর শহিদ নূর হোসেন দিবস, ২৭ নভেম্বর শহিদ ডা. মিলন দিবস, ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী, ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এছাড়া এই সময়ে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো।
এদিকে, ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুুতি নিচ্ছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ১১ সাংগঠনিক জেলার বিভিন্ন ইউনিটে ইতোমধ্যে কর্মীসভাও শুরু করেছে। ৯ বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষ করার পর প্রত্যাশা অনুযায়ী বড় জমায়েত ঘটিয়ে দেশে ও বিদেশে সাংগঠনিক শক্তি জানান দিতে চায় দলটি। সেক্ষেত্রে সব ধরনের বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ করতে চায়। যা আগামী দিনে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে চলমান আন্দোলনে গতি আনতে নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা জানান, বাকি বিভাগীয় গণসমাবেশে বাঁধা না দিয়ে সরকার নমনীয় থাকলে বিএনপি হার্ডলাইনে যাবে না। সেক্ষেত্রে ঢাকার সমাবেশ থেকে দাবি আদায়ে আলটিমেটাম দেওয়া হতে পারে। কিন্তু সরকার কঠোর হলে বড় কর্মসূচি দেওয়া হবে। ‘রোডমার্চ’ কিংবা ‘লংমার্চের’ মতো কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতনের এক দফা আন্দোনে যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘সরকার বাঁধা দেবে। কিন্তু সেই বাঁধা মানুষ মানবে না। যার প্রমাণ চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার গণসমাবেশে জনস্রোত। তবে আমরা কোনো সংঘাত চাই না। শান্তিপূর্ণভাবে রাজধানীতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ করতে চাই। সেখান থেকে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
জানা গেছে, ঢাকার মহাসমাবেশ নিয়ে নানা শঙ্কায় আছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং সর্বশেষ খুলনার গণসমাবেশে যেসব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছে, অন্য বিভাগের চেয়ে ঢাকার সমাবেশে তার চেয়ে বেশি বাঁধা-বিপত্তি মোকাবিলা করতে হবে। এ অবস্থায় সামনের কর্মসূচিগুলো কতটা শান্তিপূর্ণভাবে করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যেভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে তা সরকারকে চাপে ফেলেছে। এ অবস্থায় বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও দলীয় নেতাদেরকে শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
দলটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, বিগত সময়ে দেখা গেছে, বিএনপি হরতাল ডাকলে ক্ষমতাসীনরা পরিবহণ মালিকদের গাড়ি চালাতে বাধ্য করে, আবার সমাবেশ ডাকলে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। স¤প্রতি ময়মনসিংহ ও খুলনা সমাবেশের আগে তা-ই দেখা গেছে। বিএনপি নেতাদের ধারণা অবশিষ্ট বিভাগীয় গণসমাবেশ ও ঢাকার মহাসমাবেশের আগে গণপরিবহণ বন্ধ করা হতে পারে, বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা পথে পথে বাঁধার সম্মুখীন হতে পারে। রাজধানীর আবাসিক হোটেলসহ সর্বত্র কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে। বিষয়গুলো দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মাথায় আছে।
আরো জানান, ‘সরকার কঠোর হলে ১০ ডিসেম্বর বিএনপি বড় কর্মসূচি দেবে। কঠোর না হলে দাবি আদায়ে আলটিমেটাম দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের মানুষকে বাঁচাতে, সার্বভৌম রক্ষায় সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘তিনটি বিভাগীয় গণসমাবেশের জমায়েত দেখার পর সরকারের মন্ত্রী-এমপির বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তারা ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় আছেন। এ কারণে ক্ষমতাসীনরা কর্মসূচি পন্ড করতে অজুহাত খুঁজতে পারেন অথবা বিএনপিকে সহিংস করে তোলার উস্কানি দিতে পারেন। সেই ব্যাপারে বিএনপি সতর্ক ও সজাগ রয়েছে। এই যখন অবস্থা তখন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা থাকতেই পারে। তবে আমরা আশা করি উভয় দলই সহনীয় মনোভাব দেখিয়ে দেশে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখবে। তবেই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে।

লেখক: আব্দুর রাজ্জাক রাজা, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।