নজরুল ইসলাম: আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। সামগ্রিকভাবে আওয়ামীলীগ স্থানীয় নির্বাচনে পারফরম্যান্স দেখাতে পারে নাই। সংক্ষিপ্তভাবে বললে, দলের কিছু দুষ্ট অযোগ্য লোক নিজ স্বার্থসিদ্ধির ধান্ধায় দল করেন, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে ও ডিঙিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ বিভোর থাকেন। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক চর্চার অভাব দৃশ্যমান। দলের অর্জিত সুনামকে পুঁজি করে রাজনীতির নামে ব্যক্তি গোষ্ঠী স্বার্থে বাণিজ্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা আধিপত্য বিস্তার। এছাড়াও নৌকা মার্কা মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারলেই কে আমাকে আটকায় এই ধরনের সস্তা উদ্ভট ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ভরাডুবির কারণ প্রাথমিকভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধু যে দলের ভিত্তি দিয়েছেন, সেই দলকে এখনো বহন করে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এমপি। একাধিকবার ঘাতকের বুলেট-বোমার সামনে নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে হয়েছে, তবুও দলের হাল আঁকড়ে ধরেছেন তিনি। একারণেই বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, একটি আবেগের নামও। এই দলের সব সদস্য মিলে একটি পরিবার। এ পরিবারই বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিবার। দলটির প্রতিষ্ঠাতা নেতা-কর্মীদের মধ্যে আজ অনেকেই জীবিত নেই। সংগঠনের নীতি এবং আদর্শকে সামনে রেখে দলকে পরিচালনা করা প্রতিটি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব।
দলটি এখনো দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সকল সূচকে। দেশ এবং দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার হাত ধরে সোনার বাংলা বাস্তবায়ন স্বৈরাচারদের দৌরাত্ম ও স্বাধীনতাবিরোধীদের আগ্রাসনের কারণে, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধই ছিল এই দেশে। ফলে এসব বাঁধা প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়ানো মোটেও সহজ ছিলো না বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য।
এমন প্রেক্ষাপটে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে, দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলের হাল ধরলেন তিনি। ঘাতকেরা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত করে দলকে নতুন জীবন দান করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েকভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, লক্ষ্য স্থিরে বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আওয়ামী লীগকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
যাইহোক প্রসঙ্গে ফিরছি,স্থানীয় পর্যায়ে যে সকল নেতারা বর্তমানে চেয়ারম্যান আছেন, সকল না বেশিরভাগই নেতাকর্মীদের প্রভাব প্রতিপত্তি মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতাকে হার মানিয়েছে। এজন্য বলতে চাইছি অনেক গুলো উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে “বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়, কিছু দুষ্ট লোকেরা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে ও ডিঙিয়ে ব্যবসায়ী সেজেছেন। এদের থেকে দলকে বাঁচাতে এবং দলের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় নির্বাচন এই ধারা থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় কিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী বোর্ডকে আবারো চিন্তা করে দেখার সময় এসেছে। সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চিন্তা করেন দেশের বেশিরভাগ নাগরিক এমনটাই ভাবছেন।
স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে না বা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ইহা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যমান যেমন ধরেন, ব্রিটেনে দেখা যায় লেবার পার্টি বা লিবারেল ডেমোক্র্যাট স্থানীয় নির্বাচনে মেজরিটি ইলেকটোরাল লিড করে অতঃপর জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠন করে কনজারভেটিভ পার্টি।
একটি দেশের সকল মানুষকে একই রাজনৈতিক দল করতে হবে বা সকলকে একই রাজনৈতিক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে এমন কোন কথা নয়। আমরা সকলেই রাজনীতির ভিতরে, কেউ রাজনীতির বাহিরে নই। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের একটা অতীত ঐতিহ্য আছে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু রীতিনীতি প্রথা এখনো রয়েছে যেগুলো রাজনীতির সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে।
মনে হচ্ছে স্থানীয় সরকারের ইউপি নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষ তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও বিভাজন, প্রার্থী নির্বাচনে অদক্ষতা এমনসব কারণ থাকতে পারে যা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন ধরেন, যে সকল জনপ্রতিনিধি- কাবিখা জাইকা এডিবি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার দান-অনুদান আত্মসাৎ করার পর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ- মাদ্রাসা,মন্দির গির্জার জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি প্রণোদনার টাকা আত্মসাৎ করার লোভ সামলাতে পারেননি। যেসব জনপ্রতিনিধি গত পাঁচ বছরে একটি ইউনিয়ন পরিষদের মৌলিক সমস্যা কি চিহ্নিত করতে পারে নাই। যেসব জনপ্রতিনিধি ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহৎ স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে পারেনি। যেসব জনপ্রতিনিধি গ্রামীণ বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকেন, কথা বললেই ভোট যোগ বিয়োগ হবে সেই হিসাব কষে। যেসব জনপ্রতিনিধি নির্বাচন পূর্ববর্তী মানুষের হাত-পা ধরে ভোট ভিক্ষা চেয়ে নির্বাচিত হয়ে পরবর্তীতে সিন্ডিকেট তৈরি করে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে ইউনিয়ন পরিচালনা করেছেন। এমনসব নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত জনপ্রতিনিধিকে আবারো নৌকা মার্কা প্রতীক মনোনয়ন দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামিলীগকে শক্তিশালী করতে চাইলে এমন তো হবেই। সুস্থ ধারার রাজনীতি করেন এমন সব ব্যক্তি বিশেষের কাছে এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে।
উপরের উল্লেখিত চিত্র দেশের সামগ্রিক। গত পাঁচ বছরে দেশের প্রিন্ট টেলিমিডিয়া সামাজিক মাধ্যমে আমরা এই সমস্ত খবর দেখছি। উল্লেখ্য, আমাদের অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন যারা ভালো কাজ করছেন। তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি সমর্থন আছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগঠনের মনোনীত প্রার্থীদের কেন এমন ভরাডুবি হচ্ছে গবেষণা করে কারণ গুলো বের করতে হবে বলে মনে করছি। যতোটুকু উপলব্ধি হয়েছে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে তৃণমূল পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন একজন সৎ যোগ্য যথাযথ কর্তা ব্যক্তি নির্বাচন। তিনি যে দলেরই সমর্থিত হন না কেন নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিতে সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী বোর্ড নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভাবছেন।
লেখক: জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস (এনএইচএস) লন্ডন